প্রফেসর মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ফরাজী
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ একদিকে যেমন নতুন প্রত্যাশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনি জনমনের মধ্যেই গভীর উদ্বেগ ও সংশয়ের সঞ্চার করেছে। গত এক-দুই বছরে যা ঘটেছে, তা শুধু রাজনীতির উত্তাল সমীকরণ নয় এটি হলো দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর, সামাজিক বিশ্বাসের ও ভবিষ্যৎ-আশার এক মানসিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে “জুলাই গণহত্যা”, তার পরবর্তী সংস্কারচেষ্টা এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।
(১) প্রেক্ষাপট ও উৎপত্তি: ২০২৪ সালের জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে শুরু হয় এক প্রগতিশীল ছাত্র-অভ্যুত্থান, যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীরা উঠেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি দ্রুত আন্দোলনে পরিণত হয় এবং প্রশাসন-শিক্ষার্থী সংঘর্ষে রূপ নেয়। ইতিহাস বোধবহুল তথ্য অনুসারে, এই সময়কালে হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বলা হচ্ছে।
এই আন্দোলন সরকারের প্রবল প্রতিক্রিয়া ও তীব্র হস্তক্ষেপে সরকারের বিরুদ্ধে জনমতের বিপরীতে পরিণত হয়। এমন এক সময় এসেছে, যখন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ একেবারে নতুন ধরণের প্রশ্ন তুলছেন শুধু পরবর্তী নির্বাচন হবে কি নয়, বরং “কীভাবে হবে”, “কাদের দ্বারা হবে” এবং শাসনব্যবস্থার কাঠামো কি বদলিয়ে যাবে কি না ।
(২) “জুলাই ন্যাশনাল চার্টার” এর উদ্যোগ ও সম্ভাবনা
১৭ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ২২টি রাজনৈতিক দল (পরবর্তীতে ২৫টি দল) স্বাক্ষর করেছে জুলাই ন্যাশনাল চার্টার , যা দলীয় অধিকারমূলক ও সংবিধান সংস্কারমূলক। এই চার্টারে রয়েছে:
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা বিধান
সংবিধানের নির্দিষ্ট ধারা পরিবর্তন
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বণ্টন
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি: এই উদ্যোগে রয়েছে একটি আশা: রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার একচ্ছত্রীকরণ কাটিয়ে যেতে পারে, ক্ষমতা বণ্টন হতে পারে যৌক্তিক ও নির্দিষ্ট মেয়াদী, নির্বাচনী প্রক্রিয়া হতে পারে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক।
(৩) দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ: তবে এই চার্টারকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন এবং দ্বিধা রয়েছে ।
(ক) আইনগতভাবে কার্যকর করার প্রক্রিয়া স্পষ্ট নয়। বিএনপি অভিযোগ করেছে যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বা কমিশন-প্রক্রিয়া একতরফা, অংশগ্রহণমূলক নয়।
(খ) রেফারেন্ডাম-বিষয়ক বিতর্ক রয়েছে: কখন হবে, কীভাবে হবে নির্বাচন-দিনে হবে নাকি আলাদা হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ।
(গ) জনমনের স্তরে রয়েছে সংশয়: যদিও বড় ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু “কবে বাস্তবায়ন হবে”, “কতটা সত্যি হবে”, “রাজনীতিকরা কি পারবে” এসব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
(ঘ) জনমনের শঙ্কা ও রাজনৈতিক হালচালের ছবি ।
সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বিরল মিশ্র অনুভূতি দেখা যাচ্ছে: আশা ও সংশয়ের সমন্বয়।
একদিকে তারা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি শুনেছেন একটি নতুন গণতন্ত্র, দায়িত্বশীল শাসন, রাজনৈতিক শক্তির সীমাবদ্ধতা।
অন্যদিকে তারা ভাবছেন রাজনীতিতে এত দিনের অভ্যাস বদলাতে পারবে কি? সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বচ্ছতা কতটুকু থাকবে? দলীয় স্বার্থ কি ছাড়বে?
এই শঙ্কাগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
(ঙ) ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ
সম্ভাব্য সুযোগ:
রাজনৈতিক অপেশাদারতা ও ক্ষমতার একচেটিয়া মনোবৃত্তি কমতে পারে।
নির্বাচন স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক হলে জনগণের বিশ্বাস ফিরতে পারে।
সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল।
চ্যালেঞ্জ:
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্তঃবিশ্বাস ও অংশগ্রহণমূলক মনোবৃত্তি থাকা প্রয়োজন।
বাস্তবায়নের জন্য আইন-প্রক্রিয়া, সময়সীমা, নজরদারি ও স্বচ্ছতা অপরিহার্য।
জনমনের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা জরুরি।
বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে।
(চ) সারাংশ: বাংলাদেশের রাজনৈতিক হালচাল এখন এমন এক মোড় নিয়েছে যেখানে শুধু ক্ষমতা-হস্তান্তর নয়, রাজনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক অংশগ্রহণ নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। “জুলাই গণহত্যা” ও “জুলাই ন্যাশনাল চার্টার এর প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি একদিকে নতুন সম্ভাবনার প্রসারণ, অন্যদিকে বাস্তবায়নের পথে জটিলতা ও শঙ্কা।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, দলীয় স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের সংঘর্ষ, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও সংশয়ের মাঝখানে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা চলছে। সফল হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নের নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। ব্যর্থ হলে জনমনের হতাশা, সামাজিক ভাঙন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বাড়বে।
এখন সময়সীমা এসেছে রাজনীতিক, দলবল ও সাধারণ মানুষকে মিলে একটি দায়িত্বশীল, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রফেসর মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ফরাজী ।




