ঢাকা  সোমবার, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeখোলা কলামসাংবাদিকতার ইতিহাস, সাংবাদিক পেশা এবং কিছু মতামত!!

সাংবাদিকতার ইতিহাস, সাংবাদিক পেশা এবং কিছু মতামত!!

মুনশী শহীদুল্লাহ

সাংবাদিকতার ইতিহাস অনেক পুরাতন। সাংবাদিকতা হলো ঘটনাবলী, বিষয়, ধারণা, মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন, যা উক্ত দিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এই পেশায় শব্দ দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল অবলম্বনকে বোঝায়। মুদ্রিত, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট, এবং পূর্বে ব্যবহৃত নিউজরিল সংবাদ মাধ্যমের অন্তর্গত।

সাংবাদিকতা আধুনিক বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশা। সাংবাদিকতার যথোপযুক্ত নিয়মের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কিছু দেশে সংবাদ মাধ্যমে সরকারি হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং পুরোপুরি স্বাধীন সত্তা নাই। স্বাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক সাংবাদিকতা মুক্ত উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে সমাজের জনগণকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে সাহায্য করে।এ উপমহাদেশে সংবাদপত্রের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। বিবর্তনের মধ্যদিয়ে সংবাদপত্র শিল্প ও সাংবাদিকতা পেশা যুগ থেকে যুগ পেরিয়ে ভাষা, শিরোনাম, রিপোর্ট তৈরি, উপসম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় লেখায় নানান ধরনের পরিবর্তন এসেছে।

হলুদ সাংবাদিকতা: পাঠকরা শিরোনাম পড়েই সংবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু পাঠকরা যখন তা পড়তে যান তখন দেখতে পান যে শিরোনামের সঙ্গে সংবাদের সামান্য সঙ্গতি নেই। এ ধরনের সাংবাদিকতা হলুদ সাংবাদিকতা বলে। অর্থাৎ সহজ ভাষায় হলুদ সাংবাদিকতা হচ্ছে কোনো ভিত্তিহীন শিরোনাম দ্বারা পাঠকদের আকৃষ্ট করে তা পাঠ করতে অনেকটা বাধ্য করা।

হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস শতবর্ষ পুরনো। জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম রেন্ডলফ হার্স্টের মধ্যকার দ্বন্দের পরিণতি হচ্ছে এই হলুদ সাংবাদিকতা। ইনারা দুজন বেশ কিছু ভিত্তিহীন ও অর্ধসত্য খবর তাদের পত্রিকায় ছাপিয়ে পত্রিকার পাঠকদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে পত্রিকা বিক্রির পরিমাণ বাড়ান।

কিশোর বয়সে রাস্তায় রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করা আর মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে কাছ থেকে দেখা পুলিৎজারের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি পত্রিকা বের করার। সেখানে তিনি দরিদ্র মানুষের সংগ্রামের কথা লিখবেন এই ছিলো তার সংকল্প। তিনি সেন্ট লুইস পত্রিকায় প্রথম সাংবাদিকতা করার সুযোগ পান। সঠিক তথ্য যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমে একই সঙ্গে সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষ ও রাজনীতিকদের দুর্নীতি প্রকাশ করে পুলিৎজার অল্পদিনেই সংবাদপত্র জগতে পরিচিতি পেয়ে যান। তিনি খুব দ্রুতই একটি পত্রিকার মালিক হন ।

১৮৮৩ সালে পুলিৎজার পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এবং ‘নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি পত্রিকা কিনে নেন। সেই সময় নিউইয়র্কে নতুন অভিবাসীরা আসতে থাকেন। সেসব অভিবাসীদের জীবন চলছিলো বেকারত্ব ও দুর্দশায়। পুলিৎজার নিজেও ছিলেন একজন অভিবাসী। তিনি এসেছিলেন হাঙ্গেরি থেকে। একই অবস্থা থেকে উঠে আসা পুলিৎজার আশা করছিলেন এই অভিবাসী কর্মীদের খবর প্রকাশ করে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।

সে সময় সংবাদপত্রে শুধু সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের খবর ছাপা হত। বেশিরভাগ পত্রিকাই রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তখনকার সংবাদপত্রগুলো ছিল খুবই বিরক্তির কারণ, তৎকালীন সংবাদপত্রে সংবাদের শিরোনাম থাকত না এবং সব সংবাদই একই রকম সাইজের হরফে ছাপা হতো। পুলিৎজার সর্বপ্রথম পত্রিকায় শিরোনামের ধারা প্রচলন করেন। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পুলিৎজারের পত্রিকার গ্রাহক নিউইয়র্কে তিন গুণ বেড়ে গিয়ে পঁয়তাল্লিশ হাজারে পৌঁছায় এবং দেড় বছরের মাথায় এক লক্ষ গ্রাহক তার পত্রিকা পড়তে শুরু করেন।

আবার ধনী পরিবারের প্রাচুর্যে বেড়ে ওঠা হার্স্ট ছিলেন ছোটবেলা থেকেই উচ্চাভিলাসী। ১৮৮৭ সালে তার পিতার মালিকানাধীন পত্রিকার দায়িত্ব নেন, নিম্নমানের খবরের জন্য পত্রিকাটির খারাপ অবস্থা ছিল। তাই হার্স্ট পুলিৎজারের কৌশল অবলম্বন করে তার পত্রিকাতে শিরোনামের প্রবর্তন করেন। পুলিৎজারের মতো নতুন টাইপোগ্রাফিরও ব্যবহার করেন তিনি। এভাবে তিনি তার পত্রিকাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন।

এরপরে তিনি নিউইয়র্কে আসেন পুলিৎজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে। তবে তাদের একটা পার্থক্য ছিলো। পুলিৎজার আগ্রহী ছিলেন সমাজের খেটে খাওয়া মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে আর হার্স্টের আগ্রহ ছিল শুধুমাত্র আত্মোন্নয়ন এবং নিজেকে প্রভাবশালী করার। এজন্য হার্স্ট নিউইয়র্কে একটি পত্রিকা কিনে নেন। ঠিক সেই সময়ে পুলিৎজার নিউইয়র্কের বাইরে অবস্থান করায়, হার্স্ট মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের পত্রিকার সেরা কর্মীদেরকে নিজের পত্রিকায় নিয়ে আসেন আর নতুন নাম দেন, “নিউইয়র্ক জার্নাল”।

তার পত্রিকার প্রথম পাতার হেডলাইনগুলো ছিল অপরাধ ও স্ক্যান্ডাল জাতীয় সংবাদ এবং এর ফলে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানেই নিউইয়র্ক জার্নালের পত্রিকা দ্বিগুণ গ্রাহক পায়। এমন পরিস্থিতিতে পুলিৎজারের সঙ্গে একেবারে সমানভাবে পাল্লা দেয়ার জন্য হার্স্ট তার ১৬ পাতার পত্রিকার দাম কমিয়ে এক সেন্ট করেন যেখানে পুলিৎজারের পত্রিকার পাতার সংখ্যা ছিলো ৮ এবং মূল্য ছিলো দ্বিগুণ অর্থাৎ দুই সেন্ট। এসময়ে পুলিৎজারের পত্রিকার পাঠকরা হার্স্টের পত্রিকার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। জোসেফ পুলিৎজারও তার পত্রিকায় অতিরঞ্জণ সমৃদ্ধ সংবাদ ছাপাতে থাকেন। মোট কথা তারা দুইজনেই এক অসুস্থ মানসিকতার পরিচয় দেন।
এই ঘটনার নাম হলুদ সাংবাদিকতা যার পেছনেও এক ঘটনা আছে। পুলিৎজারের পত্রিকার এক কার্টুনিস্ট ছিলেন রিচার্ড আউটকল্ট। তার রচিত এক চরিত্র ছিলো মিকি ডুগান নামের এক বালক।

পরবর্তীতে এই চরিত্রটি “ইয়েলো কিড” নামে পরিচিতি পায় বেশ। এই ইয়েলো কিডের জন্যে পুলিৎজারের পত্রিকা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। তাই পরবর্তী বছরে হার্স্ট রিচার্ড আউটকল্টকে মোটা অংকের বেতন প্রস্তাব করে নিজের পত্রিকার জন্য এবং সেই একই ইয়েলো কিড চরিত্র ছাপাতে থাকেন। তবুও পুলিৎজার থেমে থাকেননি। তিনি অন্য এক কার্টুনিস্ট দিয়ে সেই ইয়েলো কিড চরিত্রটি আঁকিয়ে নিজের পত্রিকায় ছাপাতে থাকেন। এভাবে দুইজনের মধ্যের বিরোধ বাড়তে থাকে। আর সাংবাদিকতার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার নাম দেয়া হয় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা।

হলুদ সাংবাদিকতা ও আমেরিকা স্পেন যুদ্ধ: এই হলুদ সাংবাদিকতার জন্য দুই দেশ তথা আমেরিকা ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিলো। আমেরিকার হাভানা দ্বীপে ইউএস মেরিনের এক জাহাজ নোঙর ফেলার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আড়াইশো জন মার্কিন নাবিক মারা গেলে হার্স্ট তার পত্রিকায় ছাপান যে এর পিছনে রয়েছে স্পেনের ষড়যন্ত্র। এই ঘটনাকে নিয়ে উভয় পত্রিকাই ব্যাপক লেখালেখি করেন। চরম পর্যায়ে আমেরিকান কংগ্রেস স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা: বস্তুনিষ্ঠতা মানে হল কোনও ঘটনাকে বা বিষয়কে বাড়িয়ে বা কমিয়ে না বলা। রিপোর্টারের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ যাই থাক, কোনও মন্তব্য থাকবে না রিপোর্ট-এ। ঘটনা এবং বিষয়ে অনিবার্যভাবে একাধিক পক্ষ থাকে। পক্ষপাতহীনতা মানে সাংবাদিক কোনও পক্ষে নেই এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে সব পক্ষের কথা তথ্যের মধ্যে থাকে। ন্যায্যতা মানে দুজনের দাবিই যত ন্যায্য ভাবে সম্ভব তুলে ধরেই রিপোর্ট করা।

তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদনের গঠন এবং রিপোর্টারের নিজস্ব বর্ণনা সব কিছু ঘটনার সাথে জড়িতদের অবস্থান থেকে দূর এবং স্বতন্ত্রভাবে উপস্হাপন করতে হবে। সাংবাদিককে নিরপেক্ষ থাকতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এদেশের সাংবাদিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় চেতনা ছিলো। এখানে সাংবাদিককে অবস্থান নিতে হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। সাংবাদিকতার মূল আদর্শই হল ভিন্ন পরিসরে ভিন্ন মতামত সংগ্রহ করা এবং তা যাচাই করে পরিবেশন করা। এগুলো সবই স্বাভাবিক চ্যালেঞ্জ গণমাধ্যমের জন্য। গণমাধ্যমের এখনকার চ্যালেঞ্জটা আরও অন্যরকম।

সব মূলধারার মিডিয়া যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে সেটা হলো, নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখা। তাদের জন্য দরকার এমন ব্যবস্থা করা, যাতে তারা তাৎক্ষণিকভাবে সব খবর জানতে পারে। তাদের জন্য কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে ইন্টারনেটে সর্বশেষ খবরটা দিতেই হবে। অপেক্ষায় থাকা চলবে না, আবার একই সঙ্গে সেই তথ্য হতে হবে সঠিক। সামাজিক মিডিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে সারাক্ষণ।

আমাদের দেশে দু’একটি সংবাদ পত্র বা সংবাদমাধ্যম বাদ দিলে গণমাধ্যম হাউজগুলোর কোনও প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই। তাই তারা সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করতে পারে না ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষাও দিতে পারে না। দূর্নীতবিাজ, রাজনৈতিকনেতার ক্রোধ আর চতুরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার মর্যাদা সাহসের সঙ্গে বজায় রাখতে হবে প্রতিষ্ঠানকেই। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য এটাই সত্য। মিডিয়া প্রাতিষ্ঠানিক না হলে, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত না হলে রাজনীতিবিদদের সাথে আপোস করে গণমাধ্যম মালিকরা এবং রাজনৈতিকভাবে বিবর্জিত ইউনিয়নের নেতারা।
আমাদের সংবিধান বাকস্বাধীনতাকে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে মর্যাদাদিে ওয়া হয়েছে। সংবাদের স্বাধীনতা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। সরকারী কিংবা বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, তাদের কাজের নজরদারি করা, তার সাফল্যের বিচার করা সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য।

আমার মতামত: পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা! তবে সেটা যেন হলুদ সাংবাদিকতা না হয়! পত্রিকার সম্পাদকগণের প্রতি এই সনির্বন্ধ অনুরোধ যে, তারা যখন প্রতিনিধিদের বা রিপোর্টারদের নিয়োগ পত্র বা পরিচয় পত্র প্রদান করেন, তখন যেন তারা বিস্তারিত তথ্য যাচাইপূর্বক অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা,কর্মদক্ষতা তাদের সঠিক মূল্যায়নের পর প্রতিনিধিদের আইডি কার্ড জারি করেন বা লেখার অনুমতি দেন এবং অসত্য তথ্য সমৃদ্ধ সংবাদ প্রকাশের দায় যেন, ঐ সংবাদ কর্মীকেই বহন করতে হয়!

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular