ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeলিডসাত মাসে ২২০ জেলে অপহরণ

সাত মাসে ২২০ জেলে অপহরণ

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদসহ সংলগ্ন এলাকা থেকে গত সাত মাসে অন্তত ২২০ জেলেকে অপহরণ করেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ধরে নিয়ে যায় ১৫১ জনকে। এর মধ্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহায়তায় কয়েক দফায় তাদের ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, অপহৃত কয়েক জেলের খোঁজ এখনও পাচ্ছে না পরিবার। সর্বশেষ ১২ মে নাফ নদে আরাকান আর্মির হামলায় দুই জেলে গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় তিন জেলে অপহরণের শিকার হন। ৮ এপ্রিল চারটি ট্রলারসহ ২৩ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।

আরাকান আর্মির জিম্মিদশা থেকে ফেরত এসেছেন এমন চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তাদের মধ্যে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মো. আইয়ুব জানান, ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমা হয়ে টেকনাফের জেটিঘাটে ফিরছিল তাদের ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার মাছ ছিল ট্রলারে। হঠাৎ সাত ব্যক্তি এসে অস্ত্রের মুখে ট্রলার আটকায়। আইয়ুব যে ট্রলার ছিলেন, সেখানে মাঝিসহ ৯ বাংলাদেশি জেলে ছিলেন। ট্রলারে উঠে অস্ত্রধারীরা সবার হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। রাত ৮টার দিকে মিয়ানমারের মংডুতে নিয়ে হাত ও চোখ খুলে দেয়। পরে তাদের আরেকটি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং হাজতখানার মতো জায়গায় রাখা হয়।

আইয়ুব আরও জানান, সেখানে একটি রুমে ৩১ বাংলাদেশি ছিলেন। সব মিলিয়ে ২০০ থেকে আড়াইশ বন্দি। দুই বেলা ভাত দেওয়া হতো। ভাতের সঙ্গে কলাপাতায় কাঁঠালের এঁচোড় সরবরাহ করত। কোনো হলুদ, মরিচ বা লবণ ছিল না। লবণ চাইলে মারধর করা হতো।

আইয়ুবের দাবি, আরাকান আর্মির সদস্যরা বলত, বাংলাদেশ থেকে চাল, ডাল, হলুদ, মরিচ, লবণ, পেঁয়াজসহ খাবার পাঠালে বাংলাদেশিদের ছেড়ে দেওয়া হবে। রাতে তাদের কক্ষে কোনো আলো থাকত না বলে জানান তিনি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ৪১ দিন কাটিয়েছেন তারা। ট্রলার মালিক ফয়সালের যে ট্রলার আরাকান আর্মি নিয়ে গিয়েছিল, সেটি তারা নিয়ে আসেন বলেও জানান।

আরাকান আর্মি আটক করেছে এটা পরিবার কীভাবে জানতে পেরেছে– এমন প্রশ্নে আইয়ুব বলেন, ধরার পরপরই সবার নাম-ঠিকানা লিখে নেয় আরাকান আর্মি। শুনেছি এর পর ওই খবর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়ে দেয় তারা। আর আমাদের পরিবারের লোকজন পুলিশ, বিজিবিসহ সবার কাছ গিয়ে ছাড়িয়ে আনার অনুরোধ করেছে।

আইয়ুব আরও জানান, গেল রমজানে নাফ নদে একসঙ্গে চারটি বাংলাদেশি ট্রলারসহ জেলেদের ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এর পর ট্রলারপ্রতি ২ লাখ টাকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনে মালিকপক্ষ।

১২ মে টেকনাফের আরাকান আর্মির গুলিতে দুই জেলে গুলিবিদ্ধ এবং তিন জেলে অপহরণের শিকার হন। গুলিবিদ্ধ জেলেরা হলেন– টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার হেদায়েত উল্লাহ (১৮) ও মো. হোসেন (১৬)।

হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা পাঁচজন নাফ নদে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যাই। হঠাৎ মিয়ানমার দিক থেকে আমাদের শরীরে গুলি লাগে। এ সময় আমরা চিৎকার দিলে বাকিরা পালিয়ে যায়। আমাদের দু’জনের পা-হাতে গুলি লাগে। আমরা বাংলাদেশে জলসীমানায় ছিলাম। আরাকান আর্মি সীমান্ত চৌকি থেকে আমাদের গুলি করে। কোনো কারণ ছাড়া তারা গুলি করেছে। এখন ভয়ে নাফ নদে মাছ শিকারে যাচ্ছি না।’

১৬ এপ্রিল কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সময় আরাকান আর্মির হাতে অপহৃত ৫৫ জেলেকে ফেরত এনেছে বিজিবি। তাদের মধ্যে ১৩ বাংলাদেশি ও ৪২ জন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা টেকনাফের বিভিন্ন ট্রলারে জেলে হিসেবে কাজ করছিলেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদকের পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে নাফ নদের বাংলাদেশ অংশে মাছ ধরা বন্ধ ছিল প্রায় আট বছর। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর ছিল। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি নাফ নদে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে ২১ জন, নভেম্বর ২০, ডিসেম্বরে চার, ফেব্রুয়ারিতে ২৯, মার্চে ৮৮, এপ্রিলে ৫৫ ও মার্চে তিনজনকে আরাকান আর্মির কাছ থেকে ফেরত আনা হয়েছে।

জানুয়ারিতে টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর শুক্কুরসহ তিন জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। তাদের এখনও হদিস পাওয়া যায়নি। আবদুর শুক্কুরের স্ত্রী সাজেদা বেগম সমকালকে বলেন, ‘চার সন্তান নিয়ে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছি। তিন মাস হয়ে গেলেও স্বামীর খোঁজ পাইনি। সরকারি অনেক দপ্তরে আবেদন দিয়েছি। কোনো সাড়া মেলেনি। পরিবারের একমাত্র আয়-রোজগারের লোক না থাকায় সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছি।’

ফেরত আসা জেলে আমান উল্লাহ বলেন, ‘মাছ শিকার করে ফেরার পথে নাইক্ষ্যংদিয়া ও বাংলাদেশ সীমানা থেকে আমাদের ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। মাছ ধরতে গেলে কোনো কথা ছাড়াই গুলি করে আরাকান আর্মি। এক মাস পর ফেরত এসেছি।’

টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ নৌঘাটে সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর বলেন, ‘আগের তুলনায় নাফ নদে মাছ শিকার করা খুব কঠিন হয়ে গেছে। এখন সাগরে মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। তবে পেটের তাগিদে জেলেরা নাফ নদে নামছে। আবার অনেক সময় জেলেরা জলসীমানা অতিক্রম করার কারণেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে।’

সম্প্রতি বন্দিদশা থেকে ফেরত এসেছেন এমন আরও দু’জন জেলে সমকালকে বলেন, এপার থেকে খাবার জোগানের চেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় আরাকান আর্মি। বন্দি থাকাকালে এই ধরনের আভাস তারা দিয়েছেন।

সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর খোঁজ রাখছেন এমন একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রায় এক বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৯০ শতাংশ এলাকা দখলে নেয় আরাকান আর্মি।

বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের ওপারের অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তারা। এক পর্যায়ে নাফ নদে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সশস্ত্র সংগঠনটি। আরাকানে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করেনি আরাকান আর্মি। নির্যাতনের মুখে অনেক রোহিঙ্গা নানা কৌশলে বাংলাদেশে ঢুকছে। আরাকানের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে টেকনাফকেন্দ্রিক স্থলবন্দরেও। এখন প্রায় কার্যকর এই বন্দর।

এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে চারটি পণ্যবাহী ট্রলার আটক করেছিল আরাকান আর্মি। সীমান্ত বাণিজ্যের কমিশন দিয়েই পণ্যবাহী জাহাজগুলো ছাড়া পায়। যদিও কমিশন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে কোনো পক্ষ প্রকাশ্যে কিছু বলেনি।

বিজিবির রামুর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘জলসীমানা লঙ্ঘন করলে জেলেদের আটকে রাখে আরাকান আর্মি। ইনফরমাল যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা তাদের ছাড়িয়ে আনছি। তবে এটা শুনতে পাচ্ছি, আরাকান আর্মি ওপার থেকে খাবার যাবে– এমন প্রত্যাশা করে। তাদের খাবার সরবরাহ করার কোনো সুযোগ নেই। মাদক ও রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে নাফ নদে মাছ ধরা দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। এখনও অনেকে ককসিটে ভেসে ভেসে মাছ ধরে। ভুলবশত যদি নাফের মিয়ানমারের জলসীমায় চলে যায়, এর সুযোগ নেয় আরাকান আর্মি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular