ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeঅর্থনীতিঅর্থনীতির উল্টো পথে পুঁজিবাজার

অর্থনীতির উল্টো পথে পুঁজিবাজার

দেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরে সংকটে আছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংকট উত্তরণের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সংকট আরও বেড়েছে। বাজারে ঘন ঘন দর পতন হচ্ছে। লেনদেনের পরিমাণ একেবারেই কমে গেছে। ব্যাংক খাতে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনীতির কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি দৃশ্যমান হলেও শেয়ারবাজার যেন উল্টো পথে হাঁটছে। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা তৈরি হচ্ছে না।

ক্রমাগত লোকসানের কারণে গত ৯ মাসে ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে কেনাবেচার অ্যাকাউন্ট (বিও) বন্ধ করে দিয়েছেন। ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এই সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক এক হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে। এ অবস্থায় শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্ব নিয়ে বাজার-সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় আজ রোববার এ বৈঠক হওয়ার কথা। বৈঠকে আগামী বাজেটে শেয়ারবাজারে প্রণোদনার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক এবং বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ উপস্থিত থাকতে পারেন।

হিসাব বলছে, গত ৯ মাসে ১৭৯ কর্মদিবসের মধ্যে ১০৫ দিনই দর পতন হয়েছে। এ সময়ে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত ৩৬০ কোম্পানির মধ্যে ৩৩৬টির দর কমেছে। তালিকাভুক্ত ৩৭ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২৭টিই দর হারিয়েছে। দর হারানো শেয়ারগুলো গড় পতন ২৬ শতাংশ। ১১ আগস্টের পর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ দর হারিয়েছে ২৬১ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার।

ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১ হাজার ১১৩ পয়েন্ট খুইয়ে ৪৯০২ পয়েন্টে নেমেছে। সূচক পতনের হার ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ সময়ে বিশ্বের আর কোনো শেয়ারবাজারে এত বড় পতন হয়নি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত সরকারের পতনের পর গত বছরের ৬ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট টানা চার কর্মদিবসে প্রধান সূচক বেড়েছিল ৭৮৬ পয়েন্ট বা ১৫ শতাংশ। তখন বাজারে নতুন আশার সৃষ্টি হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ তাঁর মেয়াদকালে ৫০ লাখ বিনিয়োগকারী বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন।

কেন এই পরিস্থিতি
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল চরম সংকটে। আমদানি ব্যয় মেটাতে না পারায় নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে রপ্তানির কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছিল। ডলার সংকটে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। দেশের চলতি হিসাবের ব্যাপক ঘাটতি ছিল। এসব ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। রেমিট্যান্স ব্যাপক বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে উন্নতি হয়নি শেয়ারবাজারের।
শেয়ারবাজারের অংশীজনের অনেকেই বলছেন, দর পতনের কারণ যাই হোক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রথমত নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। মতের অমিল থাকতে পারে, তাই বলে আলোচনা না হওয়া কঙ্ক্ষিত নয়। তিনি বলেন, দেশের শেয়ারবাজার একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা থেকে বের হতে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে চেষ্টা করেছে, বিএসইসির ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে না।

কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, কমিশনের কাছে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল– অতীতে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না, এমন ভরসা তৈরি করা। অনিয়ম ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের ঘটনায় জড়িতদেরও আইনের আওতায় আনা।
১৯ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যে ১৫ বছরে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনা থেকে মাত্র ১২টি বিষয়ে তদন্ত করার জন্য বাজার মধ্যস্থতাকারী দুই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধারসহ পাঁচজনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মাকসুদ কমিশন। তদন্ত কমিটি গঠনের পরদিন রাশেদ মাকসুদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবেন। অতীতের বাকি অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেগুলো তদন্ত করতে প্রয়োজনে আরও তদন্ত কমিটি করবেন।

এমন ঘোষণার সাড়ে আট মাস পরও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। ১২টি সুনির্দিষ্ট তদন্তের মধ্যে ১০টির প্রতিবেদন জমা হলেও কয়েকজনকে কারণ দর্শানোতে শুনানিতে ডাকা ছাড়া কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

মাকসুদ কমিশনের কাছে প্রত্যাশা ছিল– অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত শেয়ারবাজার গড়তে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। দায়িত্ব গ্রহণের দ্বিতীয় মাসে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করতে পাঁচ সদস্যকে মোট ১৭টি বিষয়ে সুপারিশ দিতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্স গত সাত মাসে মাত্র মিউচুয়াল ফান্ড, মার্জিন এবং আইপিও রুলসের ওপর কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে। এটা কমিশনের চাওয়া তিনটি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাবের খণ্ডিত অংশ।

টাস্কফোর্সের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, কমিটির পাঁচ সদস্যের সবাই বড় পদে পূর্ণকালীন চাকরি করেন। তাদের পক্ষে এই বিশাল কাজ করার সময় নেই। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় দক্ষতাও অনেক ক্ষেত্রে নেই। টাস্কফোর্স সদস্য ড. আল-আমীন সমকালকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে শুরু করে বাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত মৌলিক সংস্কারের বিকল্প নেই। এ কাজ করতে গেলে বাধা আসতে পারে জেনেও তারা শেষে তা করতে চেয়েছেন।
এদিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) পদের মতো তিন শীর্ষ নির্বাহী পদ শূন্য অবস্থায় চলছে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। মাকসুদ কমিশন শূন্য পদ পূরণে স্টক এক্সচেঞ্জকে কোনো চাপই দেয়নি। দায়িত্ব নেওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেন মাকসুদ কমিশন। এর ফলে স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ডিএসইর ব্রোকারদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় কমিশনের, যা এখন আরও বেড়েছে।

বিএসইসির নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা গত ৫ মার্চ চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের কমিশন সভা কক্ষে অবরুদ্ধ করে তাদের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেন। কর্মকর্তাদের অভিযোগ ছিল, কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা অসম্মানজনক আচরণ করার এবং আইনবহির্ভূত কাজ করার চাপ দিয়েছেন। ঘটনায় ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করাসহ ২১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে মাকসুদ কমিশন।

এসব বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁর দপ্তরে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য কয়েক দিন ধরে দেশের বাইরে আছেন। আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।

বাজেটে সহায়তা কী সমাধান?
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে শেয়ারবাজার বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজার বিষয়ে তাঁকে একটি প্রতিবেদন দিতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। অবশ্য ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সুপারিশে এরই মধ্যে ঘোষণা এসেছে, আগামী বাজেটে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ এবং মূলধনি মুনাফার ওপর অর্জিত আয়ে কর ছাড় দেওয়া হবে। ভালো সরকারি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। ভালো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারমুখী করতে আকর্ষণীয় হারে কর ছাড় দেওয়ার বিষয়টিও চিন্তা করা হচ্ছে।

এমন ঘোষণার পরও শেয়ারবাজারের দরপতন থামেনি। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করা হচ্ছে। এ নিয়ে রাজধানীর মতিঝিলে বিক্ষোভ করার পাশাপাশি গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলন করেছে বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ।

করণীয় কী
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব বিষয়ে তাদের অস্বস্তি আছে, সেগুলো আপাতত দূরে রাখা। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে এবং বাজার মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে এ বাজার পরিচালনা করা যাবে না।

এক দিনে ২১ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার মতো ঘটনা নিজের সরকারি চাকরির জীবনে কখনও প্রত্যক্ষ করেননি জানিয়ে বিএসইসির সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যেই বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং পারস্পরিক অনাস্থার পরিবেশ দেখলে কোনো বিনিয়োগকারী এ বাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। এ ধরনের পরিবেশ অবসানের পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি বলে মত দেন তিনি।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন সমকালকে বলেন, শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। অতীতের মতো কিছু বাজেট সহায়তার ঘোষণা দিয়ে বাজারের বর্তমান সংকট সরকার এড়িয়ে যাবে না– এমন প্রত্যাশা করেন তিনি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular