সুমন দত্ত: বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ক সংলাপ শনিবার (৮ মার্চ ২০২৫) জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে অনুষ্ঠীত হয়। এসময় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক অধ্যাপক ড. শাফিউল ইসলাম। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. মোসলেহ উদ্দিন আহমদ তারেক, সাবেক ভিসি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জনাব ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, নিরাপদ সড়ক চাই,অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রব, ভিসি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, খন্দকার রাশেদুল হক, অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও গবেষক, ডা. নাজমুল হক রবি, বিশিষ্ট চিকিৎসক, জনাব মো: শহিদুল ইসলাম, প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট।
বক্তারা বলেন, চব্বিশের জুলাই-আগস্টের সফল বিপ্লবের মাধ্যমে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে দেশে চেপে বসা ‘একব্যক্তির’ স্বৈর-শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটেছে এবং এই স্বৈর-শাসনের নেতৃত্বদানকারী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে একটি বিশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য এদেশের আপামর জনসাধারণসহ স্বৈরাচার বিরোধী সকল রাজনৈতিকদল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণ সমর্থন করেছে।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিগত পনের-ষোল বছরে ধ্বংস-প্রায় সকল ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা । আমরা লক্ষ্য করেছি, বিগত সরকার এদেশের জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনসহ সকল পর্যায়ে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিল। ফলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এরুপ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাসহ নানা খাতের জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং অধিকাংশ কমিশনই ইতোমধ্যে সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
দেশকে নতুনভাবে গড়তে এবং এগিয়ে নিতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন একটি আলোচিত বিষয়। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন-কোনটি আগে হবে তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।আজকের সংলাপও এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে।
কোনটি আগে? জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ জনসেবার মূলক্ষেত্র
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ, নাগরিক সেবার মূল কেন্দ্রবিন্দু। জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে সরকারের কর্মীদের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন বাস্তব অর্থে সম্ভব নয়। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকার কারণে দেশের জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং জনগণ যতটুকু সেবা পাচ্ছে তা পেতে অনেক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ- একটি ওয়ারিশান সনদ গ্রহণের জন্য একজন সেবা গ্রহীতাকে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে যেতে হচ্ছে। যা খুবই সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয় সাপেক্ষও বটে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইউএনও, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনারগণ খুব ব্যস্ত থাকেন। প্রশাসনিক কাজের বাইরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব গুরুত্ব দিয়ে পালন করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না। অনেক কর্মকর্তার সাথে এ বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা এ বাস্তবতাকে স্বীকার করেছেন। জনসেবা স্থানীয় পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হলে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা প্রয়োজন।
বর্তমান সরকার একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় এসেছে। এ সরকারের কাছে জনগণের আকাঙ্খা অনেক। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সেবা বিঘ্নিত হলে সরকারের প্রতি জনসমর্থন হ্রাস পাবে। এর ফলে একটি সরকার সংস্কারের প্রতি মনোযোগী হতে পারবে না। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংস্কারের প্রতি জনসমর্থন টিকিয়ে রাখতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে সেবা নিশ্চিতের বিকল্প নেই এবং এই সেবা নিশ্চিত কিরার জন্যই দ্রুত স্থানীয় নির্বাচন করা দরকার।
সেবা প্রদানে সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা নেই
আমরা সবাই জানি, স্থানীয় পর্যায়ে জনগুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের তেমন সরাসরি কোন ভূমিকা নেই। তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে নীতি-নির্ধারণে এবং আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাই সেবা পদানের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন জনগণের অগ্রাধিকার নয়।
জনগণের জন্য য়োজন কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এটি সত্যি যে, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে জাতীয় সংসদ বাচন প্রয়োজন। কিন্তু বিগত ১৫ বছরের সমস্যাগুলো চিন্হিত করে তা নিরসনপূর্বক জাতীয় সংসদ নির্বাচন “তে হলে বেশ সময় লাগবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের মাঝামাঝি জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এ দীর্ঘ সময়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রতিনিধিত্বহীন রাখা সমাজকে দীর্ঘদিন রাখা যায় না।
এর ফলে সমাজে নানা ধরনের সংকট হতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন সহজে এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। ন্যূনতম কোন ধরনের জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া একটি রাজনৈতিক হবে আত্মঘাতী। রাজনৈতিক দলসমূহ এবং বিভিন্ন অংশীজন যদি বিষয়টি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করেন তাহলে করা হলে রাজনৈতিক দলসমূহও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। সংসদ নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ে তারা ধারণা পাবেন।
দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ
স্বাধীনতা ৫৩ বছর পরও আমরা একটি ‘নিরপেক্ষ শক্তিশালী নির্বাচন পরিচালনা কাঠামো’ গড়ে তুলতে পারি নি। আমরা ভারতকে নানা বিষয়ে সমালোচনা করলেও এক্ষেত্রে তাদের সাফল্য প্রশংসার দাবি রাখে। এজন্য নির্বাচন নিয়ে এতো আলোচনা-সমালোচনা।
যাহোক, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বাংলাদেশে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনই অবাধ-সুষ্ঠু- নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।
দেশ স্বাধীনের পর প্রথম অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে বিগত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করলেই এটিই প্রমাণিত হয়। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি- অনিয়মের কারণেই এতো রাজনৈতিক সংগ্রাম-আন্দোলন। যেমন-এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন আবার কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হতে পারে তার উদাহরণ বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪)। এসব নির্বাচনে দৃষ্টিকটু ব্যাপক কারচুপি-অনিয়ম সম্পর্কে দেশ-জাতি এমনকি বিশ্ববাসীও জানে। আজকের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সেই সব কারচুপি-অনিয়মের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরই একটি অংশ।
শুধু জাতীয় নির্বাচনই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও অবাধ হয় না, নিকট অতীতে তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিগত পনের বছরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনসমূহ। বিগত পনের বছরে গড়ে ওঠা এককভাবে রাজনৈতিক পরাক্রমশালী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারও সুষ্ঠু-অবাধ- নিরপেক্ষ স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেনি।
এর প্রমাণ বিগত ২০২৪ সালের উপজেলা নির্বাচন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বিগত সরকারের আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর এক আত্নীয়-তার সমর্থকরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মেরে মারাত্নকভাবে জখম করে। সেই প্রার্থী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ভর্তি হয়। সরকার দলীয় ক্ষমতার দাপটে প্রতিপক্ষকে হত্যা করার ঘটনাও আছে।
এরকম হাজারো ঘটনার কথা আমরা সবাই জানি। এছাড়াও সরকার দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দলীয় কঠোর সিদ্ধান্তের হুশিয়ারী দেয়া সত্ত্বেও তৎকালীন মন্ত্রী-এমপি’র ৫৪ জন আত্নীয় (ছেলে- মেয়েসহ) উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন করে এবং নির্বাচিত হয়।
সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার সংকীর্ণতার উর্ধে ওঠে এবং এসব বদনাম বা কলঙ্কমুক্ত থাকার জন্য হলেও দলীয় সরকারের বাইরে অর্থাৎ নির্দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি করা উচিত। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য অনুকূল। সেহেতু, জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এই সময়ে অনুষ্ঠিত হলে তা একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন-স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার জন্য আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। এর কারণ আমরা সবাই জানি। দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে যেমন জাতীয় নির্বাচন অবাধ- সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়নি; তেমনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়নি। ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা কম।
সেহেতু, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দলী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া একান্ত জরুরী।
প্রার্থী কেনা-বেচা, প্রভাব বিস্তার ও স্বজন প্রীতি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়-দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রার্থী বেচা কেনা হয়। স্থানীয় সংসদ সসদ্যকে বা মন্ত্রীকে এজন্য অভিযুক্ত করা হয়। এই বাইরে নিজের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী আত্নীয়-স্বজনকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হয় এবং তাদের বিজয়ী করতে দলীয় ও প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করা হয়। প্রশাসনে নিয়োজিত ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রে এসব অনৈতিক-অপকর্মে বাধ্য হয়ে যুক্ত হয় আবার আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বা ভবিষ্যৎ সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির আশায় পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করে
থাকেন।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে-শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপটেই নয়; সব সময়ই নিরপেক্ষ (নির্দলীয়/তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমান প্রেক্ষাপট একটি উপযুক্ত সময় জাতির আকাঙ্খা পূরণে তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
শিক্ষিত-যোগ্য-দক্ষ জন প্রতিনিধি আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা আরো বলে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘মাস্তান টাইপের’ প্রার্থীদের আধিক্য দেখা যায়। চাঁদাবাজি-দখলবাজি, খুন-ধর্ষণ, মাস্তানি, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়।
নির্দিষ্ট দলের আশির্বাদপুষ্ট হয়। এরকম প্রেক্ষাপটে উচ্চ শিক্ষিত যোগ্য-দক্ষ ও সৎ মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায় না। তাই চব্বিশের সফল গণঅভ্যুত্থান আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে-বাংলাদেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার।
সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ গঠন করার। একটি সুন্দর-নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শিক্ষিত-যোগ্য-দক্ষ ও সৎ ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবেন। দেশের আপামর জনসাধারণ এটিই চায়।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষা দেশের স্থানীয় পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হয়।
সরকারের বিভিন্ন আইন শৃঙখলা বাহিনী স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহজ হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় সারা দেশে বিভিন্নভাবে বিশৃঙখলা সৃষ্টির ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব বিশৃঙখলা দূর করতে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। একটি যোগ্য নেতৃত্ব এখনই দরকার এসব বিশৃঙ্খলা দ্রুত দূর করার জন্য।
নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাই
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নব গঠিত নির্বাচন কমিশনের সক্ষতা যাচাইয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংঘটিত ভুল-ভ্রান্তি দূর করার সুষ্ঠু পরিকল্পণা গ্রহণ এবং জাতীয় নির্বাচনে এসব পরিকল্পণা বাস্তবায়ন করার সুযোগ তৈরি হবে।
যা অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নির্বাচন কমিশনের জন্য এটি একটি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে ‘ইলেকশনের প্রীতি ম্যাচ’ বা ‘ওয়ার্মআপ ম্যাচ’ হিসেবে বিবেচনা করে নিজেকে ত্রুটিমুক্ত ও কৌশলী হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।
জন আকাঙ্খা পূরণ এদেশের তরুণ ভোটারসহ সাধারণ জনগণ বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন নি। চব্বিশের ছাত্র- জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানে পতিত বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার জনগণের ভোটাধিকার হরণ
লাগাতে হবে। জনগণ তাদের স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার জন্য মুখিয়ে আছে। তাদের ভোটদানের করেছিল। তাই হাজারো শহীদের জীবনের বিনিময়ে এবং আহতদের আর্তনাতে প্রাপ্ত সুন্দর সুযোগ কাজে এই আকাঙ্খা অনতিবিলম্বেই পূরণ করা দরকার।
কিছু অমূলক আশঙ্কার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ
রাজনীতির মাঠে একটি বিষয় এখন আলোচিত হচ্ছে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিলে বিগত সরকারের তারা এখন পলাতক। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা তাদের চাঁদাবাজি-দখলবাজি-নির্যাতন-ধর্ষণসহ অমূলক মনে হয়। কারণ, বিগত সরকারের যারা নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বার বা মেয়র কাউন্সিলর ছিলেন নেতৃবৃন্দ/প্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরতে পারে। আমার কাছে এই বয়ান একেবারেই নানা অপকর্মের কারণে এলাকা ছাড়া হয়েছে।
এসব নানাবিধ অপকর্মের কারণেই জনগণের সামনে তারা ভয়ে তাদের এলাকাতেই আসতে পারছে না। জনগণও তাদের অপকর্মের কারণে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এসব অপকর্মকারীরা ‘ভোটের মাঠে আসবে-প্রতিষ্ঠিত হবে’- এটি একটি অমূলক আশঙ্কা ।
জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার স্তরে নির্বাচন দিলে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সহিংসতা বা অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কার কথাও অনেকে বলছেন। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচন হলেই রাজনৈতিক সহিংসতা বেশি হয়। কারণ ‘সরকার দলীয় প্রভাব ও প্রশাসনিক প্রভাব’ দুটোই সরকার দলীয় হিসেবে মনোনীত বা পরিচিত প্রার্থীরা কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর ওপর হামলা-মামলা-সহিংস আক্রমণ চালায়।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এখানে সরকার দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসি করে। এটি এদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মনস্তাত্তিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সেহেতু, বর্তমান নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া যুক্তি সঙ্গত। এতে আইন-শৃঙখলা বাহিনীর সদস্যরা নির্ভয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবে। নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিভিন্ন ধাপে অনুষ্ঠান করার সুযোগ রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিত নিশ্চিত করা সম্ভব। এরূপ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে – এটিও একটি অমূলক ধারণ।
পরিশেষে, আমি বলতে চাই যে, সকল রাজনৈতিক দল যেহেতু জনকল্যাণের জন্যই রাজনীতি করে সেহেতু সকল রাজনৈতিক দলকে জনমত ও জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে গুরুত্ব দিতে হবে। চব্বিশের বিপ্লবের স্পিরিটকে ধারণ করতে হবে।
নতুন বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে নতুনভাবে তুলে ধরতে হবে। উন্নত-মানবিক- সাম্য ও ন্যায়ের বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
সেজন্য শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে আসতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য ঐক্যের ওপর জোর দিতে হবে। ঐক্যই শক্তি। ঐক্যই আনবে এদেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি।
জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন-এটিই প্রত্যাশা।