ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeসারাদেশটেকনাফে তিন বছরে ৪০০-৫০০ জন অপহরণের শিকার

টেকনাফে তিন বছরে ৪০০-৫০০ জন অপহরণের শিকার

মোহাম্মদ ইউনুছ অভি, টেকনাফ কক্সবাজার প্রতিনিধি : সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অবস্থান করে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা ছেলেদেরকে টাকার বিনিময়ে তথ্য দেওয়ার জন্য ভাড়া করে সন্ত্রাসীরা। কোন পরিবারে টাকা আছে, কে কোথায় যাচ্ছে, সব তথ্য চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে। সেই তথ্য অনুযায়ী অপহরণ করে তারা।

হাতে হাতে মুক্তিপণের টাকা বুঝে নেন সন্ত্রাসীরা। টেকনাফের পাহাড়ে তৈরি হয় অস্ত্র। স্থানীয় লোকদের কারণে অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসীদের তথ্য দিয়ে অপহরণকারীদের সহযোগিতা করে স্থানীয়রা। ভয়ে মুখ বন্ধ স্থানীয় সাধারণ মানুষের।

সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অবস্থান করে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা ছেলেদেরকে টাকার বিনিময়ে তথ্য দেওয়ার জন্য ভাড়া করে সন্ত্রাসীরা। কোন পরিবারে টাকা আছে, কে কোথায় যাচ্ছে, সব তথ্য চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে। সেই তথ্য অনুযায়ী অপহরণ করে তারা।পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের জন্য খাদ্যপণ্য বিভিন্ন আসবাবপত্র দোকান থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা।

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের প্রধান ব্যাবসা অপহরণ। ধরে নিয়ে গেলেই টাকা। পাহাড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে অস্ত্র তৈরির লোকজন এনে পাহাড়ে তৈরি করছে অস্ত্র। সেসব অস্ত্র দিয়ে অপহরণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।

বর্তমান অপহরণ বেড়ে গেছে উদ্বেগজনক হারে। এতে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে উখিয়া টেকনাফের ১০থেকে ১৫ লক্ষাধিক মানুষ। এ কারণে টেকনাফের পাহাড়ে সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযান চায় স্থানীয় জনসাধারণ।

স্থানীয়রা জানান, টেকনাফ বাহার ছড়া অপহৃত জসিম ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণে ছাড়া পেয়েছেন। নাম বলতে অনিচ্ছুক, জসিমের আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, সন্ত্রাসীরা খবর পাঠান পাহাড়ের রাস্তাঘাট চিনেন এমন দুজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে টাকা নিয়ে পাহাড়ে যেতে বলে। জসিমের পরিবার স্থানীয় দুজন ব্যক্তিকে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে সন্ত্রাসীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পাহাড় যায়। তাদের কাছ থেকে সন্ত্রাসীরা হাতে হাতে টাকা বুঝে নিয়ে জসিমকে দুজন বৃদ্ধের হাতে তুলে দেন। তখন জসিম নির্যাতনের শিকার হন। হাঁটতে না পারায় বৃদ্ধ দুই ব্যক্তি জসিমকে জড়িয়ে কোলে করে নিয়ে আসেন।

টেকনাফের হোয়াইক্যাং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর বাহার ছড়ার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, স্থানীয় কিছু লোক টাকার জন্য সন্ত্রাসীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের জন্য খাবারসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র বাহার ছড়ার বিভিন্ন দোকান থেকে ক্রয় করে সেসব পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারছি না।

স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় কারা এ কাজে জড়িত গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হলেই অপহরণ অনেকাংশ বন্ধ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। টেকনাফের প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত থাকলেও সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে কেউ মুক্তিপণ না দিয়ে ছাড়া পায়নি। পাহাড়ে রোহিঙ্গা স্থানীয়সহ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত অপহরণ, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র তৈরি, বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে উখিয়া টেকনাফর পাহাড়ি অঞ্চলে।

অপহৃত ও মুক্তিপণ আদায়, গত বছরের ২৮ এপ্রিল শিশু মো. সাইফ (৯) দুইদিন পর ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। পরে ২১ আগস্ট টেকনাফ মোছনী গ্রামের দুদু মিয়ার দুই ছেলে ৫ লাখ টাকার মুক্তিপণ ছাড়া পেয়েছেন। এভাবে ২৫ সেপ্টেম্বর হ্নীলার মোচনী এলাকায় মোহাম্মদ আতিক ৫ দিন পর ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণে ছাড়া পেয়েছেন।

গত বছরের ১৬ অক্টোবর টেকনাফের হোয়াইক্যং ২ কৃষক নুরু ৪ দিন পর ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। টেকনাফের বাহারছড়া থেকে অপহৃত বেলাল উদ্দিনকে (৩২) ৫ দিন পর ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করেছে। ২ নভেম্বর ৯ জন অপহরণ ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণে ছাড়া পেয়েছেন। ৩০ নভেম্বর শামলাপুর বাহারছড়া ঢালায় অপহৃত ৩ শ্রমিক ৩ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন।

গত ৫ ডিসেম্বর টেকনাফে হোয়াইক্যং জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ জহিরকে তুলে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। একসাথে অপহৃত ১৮ জন ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। জসিমসহ ৯ জনকে অপহরণ করে, ৩৭ লাখ টাকা মুক্তিপণে ছাড়া পেয়েছেন। ফজর নামাজে যাওয়ার সময় শাকের আহমদ (৬০) প্রবাসীকে অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। পরে স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানের মুখে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

টেকনাফ বাহারছড়ার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফরিদ উল্লাহ বলেন, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে অবস্থান করে বিভিন্নভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে মুক্তিপণ নিচ্ছে, কাউকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাদের কাছে ভারী অস্ত্র রয়েছে।

অপহৃত সাইফুল ইসলামের বাবা জুহুর আলম বলেন, আমার ছেলের মুঠোফোন থেকে ফোন করে মারধর করে করে মুক্তিপণ দাবি করে, টাকা কোথায় পাব বললেই আরো বেশি ছেলেকে মারধর ও নির্যাতন করে। র‌্যাব, পুলিশ নিয়ে ঝামেলা করলে ‘তোমার ছেলের লাশ হবে’ বলে হুমকি দিয়ে থাকে।

পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপহরণের শিকার হয়েছে স্থানীয় রোহিঙ্গা নাগরিকসহ অন্তত ৩০০ জন। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিতে না পেরে ৩৪ জনকে মেরে ফেলা হয়েছে। তারা টেকনাফ সদর, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে অপহরণ হয়েছিলেন।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের তথ্য বলছে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫০ জনের অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৭৮জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

গত এক বছরে টেকনাফ মডেল থানায় অপহরণের মামলা হয়েছে ১৯টি, অপহরণের শিকার ৬২ জন, উদ্ধার করা হয়েছে ৬০ জন, গ্রেফতার হয়েছে ২৯ জন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular