নিউজ ডেস্ক : জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শুরু হয়েছে আজ। এ সম্মেলনে ৩৫৪টি প্রস্তাব উঠছে।তিন দিনের এ সম্মেলন শেষ হবে বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি)।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোববার সকাল সাড়ে ১০টার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
গত বছরের মতো এবারও জেলা প্রশাসক সম্মেলনের মূল ভেন্যু রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ডিসিদের মুক্ত আলোচনা হবে। সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভা হবে। রাতে হবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নৈশভোজ।
এ বিষয়ে যুক্তি হলো, সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতে জেলা প্রশাসককে বিবাদী করে অনেক মামলা দায়ের করা হয়। মামলার মানসম্মত জবাব তৈরির কাজটি টেকনিক্যাল প্রকৃতির। উচ্চ আদালতে ইংরেজিতে জবাব প্রেরণ করতে হয়। এ জন্য ডিসি-বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আইনে ডিগ্রিধারী একজন কর্মকর্তা চেয়েছেন। এমন প্রস্তাব করেছেন ঢাকা জেলার ডিসি তানভীর আহমেদ। তবে সরকারি মামলার জন্য সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এবং অধস্তন আদালতে পিপি-জিপিরা কাজ করেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে ডিসিদের এই প্রস্তাব অযৌক্তিক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিবছরই জেলা প্রশাসক সম্মেলনে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন ডিসিরা। তবে এবার তারা আইনি ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। এ জন্য ৬৪ ডিসি এবং ৮ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স লিয়াজোঁ অফিসারের পদ দ্রুত সৃষ্টি করতে বলেছেন তারা।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার জন্য স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করা হলে ডিসিদের জন্য এমন কর্মকর্তার প্রয়োজন হবে না। জুডিশিয়াল সার্ভিস আলাদা হওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই ডিসি সম্মেলনের আগে ফৌজদারি অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা চেয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দাবি জানিয়ে আসছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মোবাইল কোর্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর কয়েকটি ধারা মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯-এর তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। কিন্তু কোনোবারই সরকারের পক্ষ থেকে এ ইস্যুতে সাড়া মেলেনি। এবারও এমন কিছু প্রস্তাব এসেছে।
বিদ্যমান পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) উন্নীত করে একজন স্বতন্ত্র ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের (আইজিপি) অধীনে আলাদা পুলিশ তদন্ত বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এসেছে। স্বতন্ত্র তদন্ত বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে ফৌজদারি মামলাগুলো যথাসময়ে এবং সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা সহজ হবে।
ঢাকা ডিসি কার্যালয়ের কর্মচারীদের জন্য বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ, ঢাকায় তীব্র যানজটের সম্মুখীন হতে হয় এবং দাপ্তরিকভাবে কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা না থাকায় নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন পরিবহনে যাতায়াত করেন কর্মচারীরা। এতে যথাসময়ে অফিসে উপস্থিতি ও অফিস শেষে বাড়ি পৌঁছতে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। এ সমস্যা সমাধানে ঢাকা জেলার ডিসি অফিসের কর্মচারীদের জন্য চারটি বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মাঠ প্রশাসন সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে মুক্ত আলোচনা হবে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের। এ সময় সরকারের উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সম্পর্কে প্রথম কার্য অধিবেশন হবে। অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্য অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। এবারের ডিসি সম্মেলনে ৩৪টি অধিবেশন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দিন রয়েছে ছয়টি, দ্বিতীয় দিন ১২টি ও তৃতীয় দিন ১৬টি অধিবেশন। প্রথম দিন স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা বিভাগের সঙ্গে দুটি অধিবেশন হবে।
একইভাবে অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন ডিসি-বিভাগীয় কমিশনাররা। এ সময় প্রতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, সচিব এবং অধিদপ্তর ও সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত থাকবেন। এবারের সম্মেলনে ৫৬টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কার্যালয় ও সংস্থা সম্পর্কে ৩৫৪টি প্রস্তাব কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব নিয়ে আলোচনা করবেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল শনিবার সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, গত বছর ডিসি সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্তের মাত্র ৪৬ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। আগের সরকারের অগ্রাধিকারমূলক অনেক বিষয় বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না। এ কারণেই অনেক বিষয় কম বাস্তবায়ন হয়েছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম জোরদার করা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এ সম্মেলনে।
কয়েকজন ডিসি জানান, প্রতিবছর ঘটা করে ডিসি সম্মেলন করা হলেও এর সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন আটকে থাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। বাস্তবায়নাধীন, চলমান অথবা বাস্তবায়ন হয়নি– এসব শব্দের আবরণে চাপা পড়ে ডিসি সম্মেলনে গৃহীত উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত। ফলে অন্য বছরের প্রস্তাবগুলো ঘুরেফিরে আবার এসেছে।
একজন জেলা প্রশাসক বলেন, ডিসিরা মাঠ প্রশাসনে কাজ করতে গিয়ে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, সমাধানের জন্য তা সম্মেলনে তুলে ধরেন। এসব সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু যেসব সমস্যার সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রশাসন জড়িত, সেগুলোর বেশির ভাগই আটকে থাকে। ডিসিরা উদ্যম নিয়ে সম্মেলনে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন। জেলার সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হয় না বলে জানা গেছে।
ডিসি-বিভাগীয় কমিশনারদের ৩৫৪ সুপারিশ :
ঢাকা জেলায় প্রধান সহকারী কাম হিসাব সহকারী পদ সৃষ্টির প্রস্তাব এসেছে। ঢাকা জেলার পাঁচটি উপজেলায় প্রধান সহকারী কাম হিসাব সহকারী পদ সৃজন করা হলেও ১৪টি রাজস্ব সার্কেলে প্রধান এ পদ সৃজন না করায় সেবা প্রদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য ১৪টি রাজস্ব সার্কেলে একটি করে প্রধান সহকারী পদ সৃজন করা যেতে পারে।
বর্তমানে ডিসি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের বদলি ও পদায়নের কাজটি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয় বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ন্যস্ত করে। এখন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের বদলি ও পদায়নের কাজটিও বিভাগীয় কমিশনারের হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
সারাদেশে ৩৬টি জেলায় দুদকের কার্যালয় আছে। এখন প্রতিটি জেলায় দুদকের কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। কার্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগেরও প্রস্তাব করেছেন তারা। তিনজন জেলা প্রশাসক এই প্রস্তাব করেছেন।
প্রস্তাবের মধ্যে আরও রয়েছে জেলা পুলিশের এসিআর দেওয়া, কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে তাদের প্রতিনিধি রাখা, ডিসির অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠন, অপরাধ ডেটাবেজ ও এনআইডি ডেটাবেজ সার্ভারে ডিসি এবং ইউএনওদের প্রবেশাধিকার, উপজেলা পরিষদের কর্মচারী নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের বদলে উপজেলার সরকারি বাসা বরাদ্দের ক্ষমতা। উপজেলা পরিষদের কর্মচারীদের নিয়োগ ও বদলি ডিসিদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্যা।