মাহবুব আজীজ: খুন আর নুন এ দেশে সবচেয়ে সস্তা– চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পর এই বাক্য প্রায়ই শোনা যেত। নুন বা লবণ এখন সস্তা নয়, তবে ‘খুন’ বেশ সস্তা। পুলিশ সদরদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে কেবল রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১৩৬ জন। সারাদেশে খুনের সংখ্যা ১২ শতাধিক। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ঢাকায় খুনের সংখ্যা ছিল ৫৫, ২০২২ সালে ৫৪, ২০২৩ সালে ৫১ ও ২০২৪ সালে ৪৭।
আজ ১৫ জুলাই, নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে, গত বছর এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠিসোটাসহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্রলীগের হিংস্র ক্যাডাররা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সেই দম্ভোক্তি– ‘আন্দোলন থামাতে ছাত্রলীগের কর্মীরাই যথেষ্ট।’ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার এই আস্ফালন নতুন নয়; ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র/শ্রমিক সংগঠন যেন তাদের আদর্শের বাহক নয়; বরং পেশিশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম হয়ে থাকে! আওয়ামী লীগ আমলের দেড় দশকে এই চিত্রের পুনঃপুন উপস্থাপনা দেশের মানুষ দেখেছে; বিশ্বজিৎ ও বুয়েট ছাত্র আবরারের নৃশংস হত্যা– সবই ক্ষমতাবলয়ে থেকে বর্বর হিংস্রতা।
বুধবার (৯ জুলাই, ২০২৫) পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত আদিম নারকীয় কায়দায় ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যা করেছে, তার বিবরণ সভ্য সমাজকে হতবাক করে দেয়। একজন মানুষকে বিবস্ত্র করে, মাথায় পাথর ছুড়ে তাঁকে খুন করছে কয়েকজন; তারপর মৃতদেহের ওপর নৃত্য করে আনন্দ-উল্লাস– এই দৃশ্য সভ্যতার ঊষালগ্নেও কল্পনাতীত! গত বছরের ৫ আগস্ট অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের পর এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এটি নিছক একটি হত্যাকাণ্ড নয়। এর নেপথ্যে আছে রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, গভীরভাবে তা ভেবে দেখতে হবে।
০২.
সমকাল ১১ জুলাই জানাচ্ছে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মিটফোর্ড এলাকার যুবদল নেতা মহিনসহ অন্যরা সোহাগকে ওই এলাকার ভাঙাড়ি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়। বিনিময়ে তাদের লাভের একটি অংশ দেওয়ার কথা। টাকার অঙ্ক বড় দেখে তারা ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। সেখান থেকেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। আরেকটি খুন হয়েছে ১১ জুলাই, খুলনায়। রামদা হাতে আলোচনায় এসে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হওয়া মাহবুব বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সমকাল আরও জানাচ্ছে, ‘মাহবুব দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তবে ৫ আগস্টের পর এলাকায় বেপরোয়া আচরণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও জমি বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা আছে।’ লাল চাঁদ সোহাগ, মাহবুব হত্যাসহ সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীর বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে দেশের নানা স্থানে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা অপরাধে জড়িতদের দ্রুত দল থেকে বহিষ্কার করছেন। সম্প্রতি এক আলোচনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘দিন শেষে জনগণের কাছেই যেতে হবে। মাত্রই আমরা দেখলাম, জনগণ যখন ক্ষিপ্ত হয়, তখন তারা কীভাবে স্বৈরাচারকে বিদায় করে। দিন শেষে জনগণই সবচেয়ে বড় কথা। তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, আপনার-আমার কোনো স্থান নেই।’ দলের শীর্ষ নেতার সতর্কবাণী থেকে শুরু করে দল থেকে বহিষ্কার– কোনো কিছুই বিএনপি নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, খুন-সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারছে না। বরং বিশৃঙ্খলা দিন দিন আরও বাড়ছে।
সন্ত্রাস, চাঁদাবাজের মূল বিষয় রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়ন– এই সংস্কৃতির শিকড় লুকিয়ে আছে ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া মানেই দেশের মালিক বনে যাওয়া, কোনো জবাবদিহিতা নেই, ভাগবাটোয়ারা করে লুটেপুটে খাওয়া! দলীয় আদর্শ, দলীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, দেশের জন্য কর্মসূচি, তার অনুশীলন– কোনো কিছু নেই।
ক্ষমতার পালাবদলে কেবল মুখ বদল হয় নেতাকর্মীর। কিন্তু সেই একই দাপুটে চিৎকার, তাদের হুকুম সাধারণ সবাইকে মানতে হবে! রাজনীতি এখানে টাকা বানানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা। আদর্শ, উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক পড়াশোনা যেন পাগলের প্রলাপ। এই অবাধ দুর্বৃত্তায়নের ফলই ধারাবাহিক খুনের বিস্তৃতি।
মানুষের জন্য কাজ করতে চাওয়াই রাজনীতি– সেখানে ব্যবসা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি মোক্ষ হয়ে গেলে তা আর রাজনীতি থাকে না। ‘কেন আপনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে চোখ বন্ধ করে রাখবেন?’– যথার্থ বলেছেন তারেক রহমান, তবে চোখ খোলার বন্দোবস্তও দলীয় কার্যক্রমে থাকতে হবে। অবৈধ ব্যবসা ও ভাগবাটোয়ারার সংস্কৃতি যদি দলের মধ্যে গেড়ে বসে, দলের দুর্বৃত্তায়নের বিস্তার রোধ অসম্ভব। দলীয় কর্মীদের কার্যপরিধি, পেশাসংক্রান্ত বিস্তারিত ভাবনাও তাই রাজনৈতিক দলের শৃঙ্খলার অন্তর্গত করতে হবে।
ঘটনার পর বিএনপি তার কর্মীদের বহিষ্কার করছে; কোন প্রক্রিয়ায় দলের আশ্রয়ে কর্মীরা দুর্ধর্ষ অপরাধীতে পরিণত হচ্ছে? এর দায় দলকে নিতে হবে এবং এ থেকে বেরিয়ে আসবার পথ বের করতে হবে।
০৩.
সোহাগ হত্যাকাণ্ডে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পাঁচজনের গ্রেপ্তারকে সরকারের সাফল্য বলে দাবি করেছেন। আইন উপদেষ্টা অপরাধীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করার আশ্বাস দিয়েছেন। সরকারি এসব আশ্বাস ও সাফল্যের দাবি অপরাধের হিংস্রতার পাশে পরিহাস বলে মনে হয়। দেশে একের পর এক হত্যা, চাঁদাবাজিতে নাজেহাল মানুষ; ছিনতাইকারীর হাতে বিবস্ত্র পর্যন্ত হচ্ছেন অসহায় পথচারী। কোথায় সরকার? কোথায় তার নিয়ম-শৃঙ্খলা, আইনি কাঠামোর সর্বোচ্চ প্রতিরোধ? একের পর এক অঘটন ঘটে যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত কার্যক্রম ও আশ্বাস প্রদান ছাড়া কার্যকর কিছু করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও যুক্ত আছেন। কিন্তু কেন খুনের পর খুন?
বারবার প্রতারণার শিকার হলে মানুষ বন্ধুকেও শত্রু জ্ঞান করে। তখন আকাশে ঘন মেঘ দেখলে সবার আগে নিজের গরু হারানোর ভয় হয়! এই ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সরকারের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ আমরা দেখছি না। এই নির্বিকারত্ব এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব মানুষকে শঙ্কিত করে। লালমনিরহাটের পাটগ্রামে আসামি ছিনতাই করার দায়ে সরকার স্থানীয় বিএনপি কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে। অথচ চট্টগ্রামের পটিয়ায় যারা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। আইন সবার জন্য সমান এবং আইনের ঊর্ধ্বে কেউই নয়– এই মৌল ধারণা নিশ্চিত করবার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের।
এদিকে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা, খুনোখুনিতে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সমর্থকদের উল্লাস ও হাস্যধ্বনি আমাদের কানে আসে। আবার অন্য কোনো শক্তি, যারা নির্বাচন না হলে খুশি, এতে যে উল্লসিত হচ্ছে না– তা-ও জোর গলায় বলা যায় না। প্রতারণায় আকীর্ণ রাজনীতির কুহকী জগৎ। সরকারকে সব কুহকের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের পথে দেশকে নিয়ে যেতে হবে। সরকারের সকল কাজে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের অগ্রাধিকার সমাজে অনেক সহিংসতা ও অপরাধ কমিয়ে আনতে পারে। দুর্বৃত্ত, প্রতারকদের সমাজ ও রাজনীতিতে জায়গা নেই কোথাও– এটিও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক