লফামারী প্রতিনিধি : দেশের নদী-নালা, খাল-বিলে আবার পাওয়া যাবে হারাতে বসা গোটালি মাছ ( বৈজ্ঞানিক নাম (Crossochelius latius )। নীলফামারীর সৈয়দপুরে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটে স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে নিবিঢ় গবেষণায় গোটালি মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন হয়েছে। এর স্বীকৃতিও মিলেছে। অত্যন্ত সুস্বাদু ও মানবদেহের জন্য উপকারী ওই গোটালি মাছ ইতিমধ্যে বিলুপ্ত প্রায় মৎস্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলো। সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সূত্র জানায়, দেশের উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য জেলাতেও গোটালি মাছ ছিলো একটি জনপ্রিয় খাবার। মিঠা পানির জলাশয় পাহাড়ি ঝর্ণা ও অগভীর স্বচ্ছ নদী ছিলো মাছটির আবাসস্থল। একসময় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও আত্রাই নদী ছাড়াও নেত্রকোণার সোমেশ্বরী, কংস, সিলেটের পিয়াইনসহ পদ্মা মেঘনা যমুনা নদীতেও প্রচুর পরিমানে মিলতো গোটালি মাছ।
গবেষণায় দেখা যায়, কৃষিতে কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, নদী, খাল-বিলে পানি শুন্যতা, নদীতে চায়না দুয়ারি জালের ব্যবহার, মৌসুমী বৃষ্টিপাতের অভাব ইত্যাদি কারণে গোটালি মাছের প্রজনন হুমকিতে পড়ে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) কর্তৃক মাছটিকে বিভিন্ন প্রজাতি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তালিকায় বিলুপ্ত প্রজাতির ২৬১টি মাছের নাম উল্লেখ রয়েছে। এরমধ্য ৬৪টি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত যা আমাদের নদী-নালা থেকে হারিয়ে গেছে।
একই সূত্র জানায়, বিলুপ্ত প্রজাতি থেকে ৪১টি মাছের প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে নিজেদের গবেষণাগারে। এ কেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের প্রযুক্তি নির্নয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। এ কেন্দ্র থেকে ইতিমধ্যে ১২টি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ উদ্ভাবন করে চাষী পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে টেংরা, লইট্টা টেংরা, বৈরালি, খলিশা, গুতুম, বালাচাটা, নাটুয়া, আঙ্গুশ, কোরমা, জারুয়া, নারকেলি চেলা ও গোটালি মাছ।
স্বাদুপানি উপকেন্দ্রেটি ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬ সাল থেকে গবেষণা কাজ শুরু হয়। গোটালি মাছ পূণরুদ্ধারে গবেষণা শুরু হয় ২০২৩ সালে। তিস্তা অববাহিকা থেকে সংগ্রহ করে গবেষণাগারে আনা হয়। এখানে চলে নিবিঢ় গবেষণা। এখানে একদল বৈজ্ঞানিকের সার্বিক সহযোগিতায় মাছটির পোনা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। এ টীমে ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী, কেন্দ্রটির উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোনিয়া শারমীন, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শ্রীবাস কুমার সাহা। টীমটি গবেষণা শেষে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গোটালি মাছের পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয়।
সরজমিনে স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে গেলে কথা হয় গবেষকদের সাথে। উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ বলেন, আমরা খুবই আনন্দিত। বাঙালির পাতে আবার ফিরিয়ে আনতে পেরেছি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ। তিনি গোটালি মাছে বৈশিষ্ট তুলে ধরে বলেন, মাছটি অত্যন্ত স্বাদ ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ। মাছটির মাথা চ্যাপ্টা ও শরীর লম্বা আকৃতির। সমবয়সী প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছের চেয়ে আকারে বড় হয়। মাছটির দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১২ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১৫ থেকে ১৭ গ্রাম হয়ে হয়ে থাকে। মাছটির প্রজননকাল জুন থেকে জুলাই মাস।
সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজহার আলী জানান, চলতি মাসে আমাদের গবেষণাকে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ময়মনসিংহ গবেষণার স্বীকৃতি প্রদান করেন। সে ধারাবাহিকতায় আগামি বছরের মাঝামাঝি সময়ে মাছটি চাষী পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ফলে এ মাছ খাল-বিল ও নদী-নালায় সহজে মিলবে। তিনি বলেন, গোটালি মাছ ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৭-৮ ঘন্টার পর স্ত্রী গোটালি ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার পর হাপা থেকে ব্রুড সরিয়ে নিতে হয়। ডিম ছাড়ার ৮-১০ ঘন্টা পর ডিম থেকে রেণু বের হয়। ধাপে ধাপে নার্সারী হিসাবে ব্যবহার করা যায় এবং সঠিক পরিচর্যায় ৫০-৬০ দিনে মধ্যে আঙ্গুলি পোনায় পরিণত হয়।