অলোক আচার্য
দেবী দুর্গা চলে গেছেন বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে তবে ধরাধামে রয়েছেন দেবী লক্ষী। যিনি মা দুর্গার সাথেই এই মর্ত্যে এসেছেন। তিনি এখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে অবস্থান করছেন। ফলে আনন্দটুকু শেষ হয়েও আবারও ফিরে এসেছে। হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান দেবী হলেন দেবী লক্ষী। দেবী লক্ষী সনাতন ধর্মীদের ঘরে ঘরে পূজিত হন। সেই আদিকাল থেকেই ভক্তিসহকারে দেবী লক্ষীর পূজা করা হয়ে থাকে। দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার পর মায়ের বিসর্জন দেখে যখন একটা মন খারাপের রেশ তৈরি হয়, তখনই পুজো পুজো গন্ধ নিয়ে আবার মর্তলোকে এসে উপস্থিত হন সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবী মা লক্ষী। বাঙালির ঘরে ঘরে সকল মানুষ আবার মেতে ওঠেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপূজা শেষ হওয়ার পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি আনন্দদাত্রী, মঙ্গলময়ী। বাঙালি হিন্দুসমাজে দেবী লক্ষী একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। সারাবছর ধরে বাংলায় দেবীর আরাধনা হয়। প্রতিটি বাঙালির গৃহে পাতা হয় লক্ষীর আসন, সেখানে থাকে দেবীর ঘট, সিঁদুরকৌটো, কাঠের পেঁচা অথবা মাটির পেঁচা, কড়ি, দেবীর ছবি।
এদিন ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার বাঙালির ঘরে ধর্মপ্রাণ বধূ লক্ষীর পাঁচালি পড়েন, পুজো শেষ হলে ঘরে দেওয়া হয় আল্পনা, বিতরণ হয় প্রসাদ। এই দিনে লক্ষী পূজা করা এক ধরনের রীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে প্রধান লক্ষীপুজা কয়েকটি মাত্র। ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবার ভাদ্রলক্ষী পুজো, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষী পুজো, কার্তিকের দীপান্বিতা অমাবস্যারর মহালক্ষী পুজো, অঘ্রান সংক্রান্তির ক্ষেত্রলক্ষী পুজো, পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের পৌষলক্ষী পুজো, মকরসংক্রান্তির অরুণা লক্ষী পুজো, মাঘ মাসের প্রথম দিনের উঠোন লক্ষী পুজো, চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বৃহস্পতিবারের চৈতে লক্ষী পুজো। তবে দুর্গাপূজা শেষে যে লক্ষীপুজা সেটিই আশ্বিনমাসের শারদপূর্ণিমার কোজাগরী লক্ষীপুজো।
সাধারণত লক্ষীদেবী ধনসম্পদ বা ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি পার্থিব উন্নতি, মঙ্গল,জ্ঞান,সৌভাগ্য,দানশীলতা,সাহস ও সৌন্দর্যের দেবীও তিনি। পূজার জন্য নানা উপাচার প্রয়োজন হ৯য়। দেবীর মূর্তি না থাকলে কলার বের বা বেড়ী লক্ষী তৈরি করতে হলে কলার বাকলকে গোল করে নারকেলের নতুন কাঠি দিয়ে আটকানো হয়। তাতে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা চিহ্ন আঁকা হয়। কলার বাকল দিয়ে তৈরী এই চোঙাকৃতি ভিতরে নিচুনি রাখা হয়। কাঠের আসনের উপরে লক্ষীর পা অঙ্কিত আলপনার উপরে ৯টি চোঙা রাখা হয়। এই নয়টি বাকলের মধ্যে পঞ্চশস্য দেওয়া হয়। সর্বশেষে শীষযুক্ত নারকেল রেখে লাল চেলি দিয়ে ঢেকে বউ সাজিয়ে দেবী লক্ষীকে কল্পনা করা হয়। পূরাণ মতে, কোজাগরী শব্দটি এসেছে ‘কো জাগর্তি’ থেকে, যার অর্থ ‘কে জেগে আছো’।কথিত রয়েছে, এই পূর্ণিমার রাতে নাকি দেবী লক্ষ¥ী জগৎ পরিক্রমায় বেরোন। তিনি দেখেন কেউ সারারাত জেগে আছেন কিনা। এটা প্রচলিত ধারণা যে, ওইদিন রাতে যে ব্যক্তি জেগে থাকেন এবং পাশাখেলা করেন তাঁকে মা লক্ষী ধনসম্পত্তি দান করেন।” কোজাগরী লক্ষীপুজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি সমাজ। অর্থাৎ দেবীর কাখে যে কলসী থাকে সেখানে পূর্ণ থাকে ধান দিয়ে। এর অর্থ হলো ধান পূর্ণ ঘরে কোনো অশান্তি আসে না। সম্পদ থাকে পূর্ণভাবে। লক্ষী দেবীর পূজার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আলপনা। এই পুজো হয় মূলত প্রতিমা, সরা, নবপত্রিকা কিংবা থোড়ের তৈরি নৌকোয়। লক্ষীর সরাও হয় নানারকমের।
লক্ষীপূজা উপলক্ষে নাড়িকেলের নাড়–,মোয়া তৈরি করা হয়। লক্ষীপূজা উপলক্ষে শুক্রবার ও শনিবার পূজারিরা ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়। বৈদিক শাস্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে পূজিতা দেবী লক্ষী বাঙালির ঘরের দেবী। ঘরের চঞ্চলা,চপলা মেয়ে। কোনো মেয়ের যদি ভালো গুণ থাকে তাহলে তাকে লক্ষী দেবীর সাথে তুলনা করা হয়। দুর্গাপুজো যেখানে বারোয়ারি পুজো, সেখানে প্রতি ঘরে ঘরে মেয়ে-বৌমারা মিলেই লক্ষী দেবীর ঘট পেতে পুজো করে ফেলেন অনায়াসে। গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির সাথে লক্ষ¥ীপুজো প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে নানারকম রীতি, আচার দেখা যায় আর দেখা যায় নানারকমের আল্পনা যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে লক্ষীপুজোর সাথে। গ্রামাঞ্চলে এখনও ঘরের উঠোন, সদর দরজা থেকে পুজোর বেদী, ধানের গোলা পর্যন্ত আল্পনায় ধানের ছড়া আর তার দুপাশে ছোট ছোট পায়ের ছাপ এঁকে দিতে দেখার রীতি দেখা যায়। দেবী সেই আল্পনায় হেঁটে হেঁটে গৃহে প্রবেশ করবেন এমনটাই বিশ্বাস সনাতন ধর্মীয়দের। তাই প্রতি বছর দুর্গা পূজা শেষে ভক্তিসহকারে লক্ষী পূজার আয়োজন করা হয়। ঘরে ঘরে চলে পূজার ব্যস্ততা। নানা রকম নাড়–,মোয়া তৈরির ধুম চলে। লহ্মœী পূজাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় চিরায়ত বাংলা।