নিউজ ডেস্ক: আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক রাজনীতির চরম উত্তেজনায় পৌচেছে। যা দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে ছেদ পড়েছে। তবে, এবারের প্রেক্ষাপট শুধু বাণিজ্যক নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে নিত্যপণ্য চাল, পেঁয়াজ ও আলু রফতানি বন্ধ’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সে দেশের এক রাজনীতিবিদের বক্তব্যের জেরে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের বিষয়টি এখন রাজনীতির আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে টপ টু বোটম পর্যন্ত।
গত সোমবার পেট্রাপোল স্থলবন্দরের কাছে ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন’ বন্ধ এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মুক্তির দাবিতে এক সমাবেশে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী ভারত থেকে আলু ও পেঁয়াজ আসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। এতে আগে থেকেই আলোচনায় থাকা এ ইস্যুটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও তর্ক-বিতর্ক বাড়ে।
এদিকে বাংলাদেশের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন তাদের (ভারতের) রাজনৈতিক বক্তব্য যাই হোক, তাদের ব্যবসায়ীদের স্বার্থও দেখতে হবে। যে কারণে বাণিজ্যিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
ভারত থেকে সর্বশেষ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার, তথ্য ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। বাংলাদেশে রফতানিকারকদের তালিকায় চীনের পরেই দেশটির অবস্থান।
কিন্তু, উল্লিখিত তিন পণ্য- আলু, পেঁয়াজ ও চালের ক্ষেত্রে ভারতের ওপর আদতে কতটুকু নির্ভরশীল বাংলাদেশ তা এখন মূখ্যম প্রশ্ন হয়ে উঠেছে?
আলু- বাংলাদেশে ২০২৩ সালের আগে কখনো আলু আমদানিই করা হয়নি। দেশটি আলু রফতানি করত। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য ওই বছরের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটি থেকে ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের আলু আমদানি হয় বাংলাদেশে। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশে আলু উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছিল এক কোটি ১৬ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ছয় লাখ মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়। তবে, দেশে আলুর চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ, উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম নয়।
আলু যেহেতু কোল্ডস্টোরেজে রাখা যায়, এই সুযোগটা ব্যবসায়ীরা কাজে লাগায়, মজুদ করে রাখে।’ বলছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হাসনীন জাহান। এর ফলে দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। যে কারণে আমদানির দিকে যায় সরকার।
আলু যদি সরাসরি বাজারে দিয়ে দিতে পারত কৃষক, অর্থাৎ, সরবরাহ যদি স্বাভাবিক থাকত, আমদানি নির্ভরশীলতা কমানো যেত, বলেন অধ্যাপক জাহান।
পেঁয়াজ- ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৩৭ লাখ মেট্রিক টন লাখ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। সেই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রায় ৩৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে এ বছর। কিন্তু, এ বছরও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পেঁয়াজ-রসুন জাতীয় পণ্যের রফতানির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রায় ২০ কোটি ডলারের পণ্য পাঠিয়েছে তারা।
বাংলাদেশে বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানিয়েছিলেন মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তৎকালীন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার। তার মতে, এর পুরোটাই দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব।
তবু কেন আমদানি করতে হয়? এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ হাসনীন জাহান বলেন, পেঁয়াজের বেলায় প্রজেকশন (পূর্বাভাস) ঠিকমতো করা হয় না। কৃষক হয়ত এক বছর দাম পাচ্ছে না, ফলে পরের বছর কম চাষ করে। কিংবা এক বছর দাম বেশি পেলে পরের বার চাষের পরিমাণ বাড়ে, ব্যাখ্যা করেন তিনি।
তথ্যের ঘাটতি না থাকলে এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ও বাজারব্যবস্থায় তদারকি ঠিকমত করা গেলে আমদানি এড়ানো যেত বলে মনে করেন তিনি।
চাল- আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশকে ধান-চালের নিরিখে ‘খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’ বলে দাবি করা হতো। কিন্তু, তারপরও চাল আমদানি থেমে থাকেনি। ভারত থেকে বাংলাদেশে চাল আমদানির তথ্যে বছরভেদে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। একেক বছরে আমদানির পরিমাণ একেক রকম।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেড় কোটি ডলারের চাল রফতানি করা হয়েছিল বাংলাদেশে। তবে এর আগের অর্থবছরে ৩১ কোটি ডলারের চাল বাংলাদেশে রফতানি করা হয়।
সর্বশেষ অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার কোটি ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় চার কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন।
জাতিসংঘের বাণিজ্য বিষয়ক ডেটাবেইজ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আট কোটি ডলারের বেশি চাল রফতানি করেছে ভারত। পরিমাণের দিক থেকে দুই লাখ ১৫ হাজার টন প্রায়। ভারত ছাড়াও ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ড থেকে চাল আনে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) থেকে গত এপ্রিলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস করা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের চাল আমদানি শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসতে পারে।
চলতি বছর বোরোর ভালো ফলন এবং আউশ-আমনের পরবর্তী মৌসুমের কথা বিবেচনায় নিয়ে সংস্থাটি বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করতে পারে দেশটি।
বোরোর ভালো উৎপাদনের কথা উল্লেখ করে কৃষি অর্থনীতিবিদ হাসনীন জাহান বলেন, সমস্যাটা হয় ডিস্ট্রিবিউশন (বণ্টান) পর্যায়ে। মজুদদারি ঠেকিয়ে সরবরাহব্যবস্থা মজবুত করা গেলে চালের মূল্য বৃদ্ধি বা যোগান সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মন্তব্য তার।