মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: বাইক্কা বিল পর্যটকদের প্রিয় স্থানগুলোর একটি। এই এলাকার মূল আকর্ষণ নানা প্রজাতির নজরকাড়া পাখি। শীত এলেই অতিথি পাখির কিচির মিচির আর নানা জাতের রংবেরঙের পাখির কলকাকলি, খুনসুটি, ওড়াউড়ি ও পানির ভেতর ডুব দেওয়া আর দল বেঁধে সাঁতার কাটার দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হন পর্যটকরা। কিন্তু এ বছর বিলে অন্যান্য বছরের মতো পাখি নেই। দিনে দিনে পাখির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ১০ বছর আগের সঙ্গে বর্তমানের হিসাব করলে পাখির সংখ্যা ২০ ভাগে নেমেছে। ফলে বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে আসা পাখী প্রেমীরাও পাখি না পেয়ে ফিরছেন হতাশা হয়ে।
সম্প্রতি দেশ বার্ড ক্লাবের আয়োজনে শেষ হওয়া পাখি শুমারিতেে এসব তথ্য উঠে এসছে। স্থানীয় সংবাদকর্মীদের নিয়ে এ পাখি শুমারি করা হয়।
অথচ এই বাইক্কা বিলে হাজার হাজার পাখি একসময় পুরো বিল দখল করে রাখত।পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত বিল।কথাগুলো বলছিলেন বাইক্কা বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতা আসা ও পাখি প্রেমীকরা।
গত শনিবার বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য ও বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ ডঃ পল থমসনের তত্ত্বাবধানে পাখিশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। এই পাখিশুমারিতে আরও উপস্থিত ছিলেন ইসরাত জাহান এবং সামিউল মোহসেনিন।
সংশ্লিষ্ট পাখি বিশেজ্ঞরা বলেন, ১০ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে পাখির সংখ্যা ২০ ভাগে নেমে গেছে। অথচ এই বাইক্কা বিলে এক সময় হাজার হাজার পাখি পুরো বিল দখল করে রাখত।
পাখি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে পাখি বিশেজ্ঞরা স্থানীয় মানুষের অসচেতনতা, পাখি শিকার, এবং তাদের আবাসস্থল জলাভূমির দিকে নজর না রাখাকে দায়ী করছে।
তারা বলেন, পাখি কমে গেলে মাছও কমে যাবে। যখন পাখিরা আসে তখন জলাভুমিতে মাছ ধরা পড়ে। সাধারণেরও আনাগোনা বেড়ে যায়। তাই শিকারের ভয়ে অর্থাৎ পাখিরা যখন বুঝে নেয় তাদের আবাসস্থলটি নিরাপদ নয়, তখনই পরবর্তী বছরে পাখির আনাগোনা কমতে থাকে। এছাড়া পরিযায়ী পাখি যখন যেখান থেকে তারা আসে সেখানে প্রজনন অবস্থা কি রকম ছিল বা যে পথে আসা যাওয়া করে সেই পথের সার্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। এমনকি বাইক্কাবিলের বাহ্যিক অবস্থা যে পরিমাণে গভীরতা, জলজ উদ্ভিদের পরিমাণ, প্রাচুর্য্য এসবের উপর নির্ভর করা কথা থাকলেও সেরকম আবাসস্থল নেই।
জানা যায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩৮ প্রজাতির ৭৮৭০টি পরিযায়ী পাখি বিচরণ করছে। ২০২৪ সালে ছিল ৩৩ প্রজাতির ৪৬১৫টি। ২০২৩ সালে ৪০ প্রজাতির ৬১৪১টি পরিযায়ী পাখি পাওয়া গিয়েছিল বাইক্কা বিলে।
রোববার বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের পাখি পর্যবেক্ষণ এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারবেশন সোসাইটির প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সামিউল মোহসেনিন এ তথ্য জানান।
বাইক্কাবিলে হাঁস জাতীয় পাখি দেখে গেছে। এর মধ্যে উত্তুরে খুন্তে হাঁস, পিয়াং হাঁস, মরচেরং ভুতি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, ধলা বালি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস প্রভৃতি। বাইক্কা বিলের জন্য নতুন চারটি জলচর পাখি উত্তুরে টিটি আমরা পেয়েছি। যা ইতোপূর্বে বাইক্কা বিলে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক কাজল বলেন, ছোট বেলা থেকেই বাইক্কা বিলে যাওয়া আসা যাওয়া করি। একসময় কত ধরনের পাখি দেখা যেত। কত পাখির ছবি এই বাইক্কা বিল থেকে তুলেছি। কিন্তু এখন দিন দিন পাখির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। পাখি শিকার করে, পাখিরা ভয়ে এখন আসে না। তা ছাড়া বাইক্কা বিলে যাওয়ার জন্য বড় পাকা রাস্তা হয়েছে। পর্যটকেরা অনবরত গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। পাখিরা এসব ভয় পায়।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক সুমাইয়া শিমু বলেন, বাইক্কা বিল নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। বাইক্কা বিলে অনেক পাখি রয়েছে এ ধরনের ভিডিও দেখেছি। বাস্তবে এসে দেখলাম কিছুই নেই। এখানে এসে হতাশ হলাম। হাতে গোনা কয়েকটি পাখি পেয়েছি। সেগুলোও অনেক দূরে থাকে।
বাইক্কা বিল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মিন্নত আলী বলেন, এ বছর পাখির সংখ্যা অনেক কম। এ বছর বিলের কচুরিপানা বিল থেকে সরে যাওয়ায় পুরো বিল প্রায় ফাঁকা দেখা যাচ্ছে। পাখিরা এসব কচুরিপানা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের ওপরেই বেশি থাকে। বিলের কিছু অংশে শাপলা-পদ্ম টিকে থাকলেও জলজ উদ্ভিদ প্রায় নেই। পাশাপাশি বাইক্কাবিলের প্রচুর পর্যটক আসায় পাখিরা একটু দূরে থাকে। অনেক পর্যটকই পাখিদের বিরক্ত করে। পাখি শিকার হয় কি না, জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, স্থানীয় কিছু মানুষ শিকারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বর্তমানে আমাদের পাঁচজন লোক বিলের পাহারায় থাকেন। কয়েক দিন আগেও শিকারির উৎপাত ছিল। এখন সেটা নেই।
শ্রীমঙ্গল সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিনয় কুমার রায় বলেন, ‘বিলের পাখি এখন আর কেউ শিকার করে না। এখানে বিলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। তারাই পাহারার ব্যবস্থা করে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য ও বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ ড. পল থমসন বলেন, এ বছর বাইক্কা বিলে শীতকালীন জলচর পাখি গণনা করে তারা ৩৮ প্রজাতির ৭ হাজার ৮৭০টি পাখির দেখা পেয়েছেন। এ সংখ্যা বিগত দুই বছরের চেয়ে বেশি।