ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeসারাদেশবিনা পারিশ্রমিকে তিন হাজার কবর খুঁড়েছেন মনু মিয়া

বিনা পারিশ্রমিকে তিন হাজার কবর খুঁড়েছেন মনু মিয়া

মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ এলাকার কারও মৃত্যুর খবর পেলেই তড়িঘড়ি করে খুন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাতসহ কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে ছুটে যান ৭৩ বছর বয়সী আলোচিত গোর খোদক মো. মনু মিয়া। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে ঘোড়ার পিঠে চেপে চলেন তিনি। মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে কবর খোঁড়া শেষ করে দাফন পর্যন্ত সেখানে থাকেন তিনি।

দাফন শেষ হওয়ার পর আবার সব যন্ত্রপাতি ব্যাগে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাড়ির পথে রওনা হন। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের ৭৩ বছরের বৃদ্ধ মনু মিয়ার ঘোড়ায় চড়ে এমন উদ্দাম গতির ছুটে চলা দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারেন নিশ্চিত কারও মৃত্যু হয়েছে। কবর খোঁড়ার পর মৃত ব্যক্তির পরিবারের কারও কাছ থেকে নেন না পারিশ্রমিক বা যাতায়াত খরচ। এলাকার সবার কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র তিনি।

পরিচিতি পেয়েছেন শেষ ঠিকানার কারিগর হিসেবে। পাড়া-পড়শিরা জানান, মনু মিয়া খুব সহজ-সরল একজন ভালো মানুষ। বর্তমান সময়ের স্বার্থ ছাড়া কাউকে কোনো কাজে পাওয়া যায় না, কিন্তু সেখানে মো. মনু মিয়া বিনাপারিশ্রমিকে মানুষের বাড়িতে গিয়ে কবর খুঁড়ে দিয়ে আসেন- এটা খুবই বিরল ঘটনা। চাহিদাবিহীন এই মানুষটির নেই অঢেল টাকা-পয়সা, সম্পত্তি। কিন্তু তার নীতি-নৈতিকতা মুগ্ধ করে এলাকার সবাইকে। এই বুড়ো বয়সেও কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া সারাটা দিন তিনি যে পরিশ্রম করেন সেটা যে কোনো যুবক করলেও হাঁপিয়ে উঠবে- এমন আলোচনা সবার মুখে। স্ত্রী রহিমা আক্তারকে (৫৬) নিয়ে নিজের সৎ উপায়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে ছোট সংসার চলছে- এতেই খুশি মনু মিয়া। স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. সাইফুল ইসলাম এ প্রতিনিকে বলেন, মনু ভাই খুব ভালো মানুষ। আমরা ছোট সময় থেকেই দেখে আসছি তিনি বিনাপারিশ্রমিকে মানুষের কবর খোঁড়েন। তার মতো এমন ভালো মানুষ আমাদের এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছে- এতেই আমরা গর্বিত। মনু মিয়া কবর খোঁড়ার কাজ শুরু করেন ১৯৭২ সাল থেকে। নিজে পড়াশোনা না জানলেও কবর খুঁড়ে এসে মানুষকে দিয়ে ডায়েরিতে সুন্দর করে লাশের নাম, ঠিকানা, তারিখ লিখে রাখেন তিনি। ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী, এ যাবৎ তিন হাজার চল্লিশ জনের কবর খুঁড়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সাহাব উদ্দিন ঠাকুরসহ বিশিষ্টজনদের কবর। জীবনের বাকি সময়টুকু এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান মনু মিয়া।

নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান মনু মিয়ার মা সারবানুর মৃত্যু হয় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। মায়ের কবর তৈরিতে অংশ নেন কিশোর মনু মিয়া। সেই থেকে শুরু। ৫৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিনাপারিশ্রমিকে নিজের টাকা খরচ করে কবর খোঁড়েন। বাবার জমি বিক্রি করে ঘোড়া কিনেছেন। যন্ত্রপাতি তৈরি করতে খরচ হয়েছে লাখ টাকা। সংসার চলে টেনেটুনে। এতে কোনো কষ্ট নেই তার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মনু মিয়া তৃতীয়। কবর খোঁড়ার কাজে বাহন হিসেবে এ পর্যন্ত তিনি চৌদ্দটি ঘোড়া কিনেছেন। আর এ জন্য বিক্রি করতে হয়েছে বাবার জমি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটি জমি বন্ধক দিয়ে বর্তমানে চলে তার সংসারসহ কবর খোঁড়ার ব্যয়। মনু মিয়ার স্ত্রী থাকলেও কোনো ছেলে-মেয়ে নেই।

গোরখোদক মনু মিয়া এ প্রতিনিধিকে বলেন, মানুষের দেখাদেখি শখের বশে কবর খুঁড়তে খুঁড়তে এখন এটা নেশা হয়ে গেছে। কোথাও মানুষ মারা যাওয়ার খবর পেলেই মনটা ছটফট করে। দ্রুত খুন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাতসহ কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে ছুটে যাই। সুন্দর করে কবর খুঁড়ে, দাফন সম্পন্ন করে তারপর বাড়িতে আসি। আমি কবর খুঁড়ে কারো কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেই না। আমি স্বেচ্ছায় এই কাজটি করতে ভালোবাসি। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই, আমি জীবনের বাকি সময়টুকু মানুষের কবর খুঁড়ে কাটিয়ে দিতে চাই।

নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলাসহ হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলাতেও বহু কবর খনন করেছেন তিনি। কবর খোঁড়ার একজন নিখুঁত, সুদক্ষ এবং সুনিপুণ কারিগর হিসেবে নিজের জেলাসহ পাশের জেলা হবিগঞ্জেও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে মো. মনু মিয়ার।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular