ঢাকা  বৃহস্পতিবার, ২রা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ১৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeখোলা কলামমুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও প্রকৃত ‘রিসেট বাটন’

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও প্রকৃত ‘রিসেট বাটন’

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ অধিবেশন যোগ দিতে গিয়ে নিউইয়র্কে অবস্থানকালে ভয়েস অব আমেরিকাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ‘ছাত্ররা রিসেট বাটন পুশ করেছে’ মর্মে বক্তব্য দিয়ে বড়সড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলেন । অনেকেই ব্যাখ্যা করছিলেন, তিনি রিসেট বাটন পুশ করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার স্পর্ধিত অপপ্রয়াস দেখাতে চেয়েছিলেন। স্বস্তির বিষয়, ১০ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ‘রিসেট বাটন’ চাপার কথাটি উল্লেখ করে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, যা বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে, অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, সেটি থেকে বের হয়ে এসে নতুনভাবে শুরু করার কথা বুঝিয়েছেন। তিনি কখনোই বাংলাদেশের গর্বিত ইতিহাস মুছে ফেলার কথা বলেননি। এখানে উল্লেখ্য, কেউ যখন কোনো ডিভাইসে রিসেট বোতাম চাপেন, তখন তিনি নতুন করে ডিভাইসটি চালু করতে সফটওয়্যার সেট করেন। এতে হার্ডওয়্যার পরিবর্তন হয় না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার।

আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের অমোচনীয় অধ্যায়। খোদ মুহাম্মদ ইউনূস মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, লাখো পরিবারের স্বজন হারানোর বেদনা পেরিয়ে, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘রিসেট বাটন’ পুশ করার বিষয়ও নয়। বিভিন্ন সময়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলতে চেয়েছে, কিন্তু সফল হয়নি। এমনকি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়েও অনেক অর্বাচীন ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে; শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। সম্প্রতি এমন একটি বিতর্কে আমি লিখেছিলাম- ‘জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অপচেষ্টা এবারও ব্যর্থ হতে বাধ্য’ (সমকাল, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। বলা বাহুল্য, অপচেষ্টাটি ইতোমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা কী? আর প্রকৃত রিসেট বাটনই বা কোথায় পুশ করতে হবে? আমরা জানি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন। বাস্তবে তাঁর সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে এদেশে পুঁজি-লুণ্ঠনের সর্বনাশা ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ চালু করেছিলেন।

এটা ঠিক, ওয়ান-ইলেভেনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের মাধ্যমেই তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল। দুর্ভাগ্য, ওই ভূমিধস বিজয় তাঁকে সম্ভবত আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকার সর্বনাশা খায়েশে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যে কারণে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। অনেকের মনে আছে, ২০১৮ সালের রাতের বেলা সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলার ব্যাপারটি আমিই প্রথম প্রত্যাখ্যান করেছিলাম দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক কলামে। বলেছিলাম, এই নির্বাচন শেখ হাসিনার চূড়ান্ত পতন ডেকে আনবে। বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজের পতন ডেনে এনেছেন।

জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এত লুটপাট ও দুর্নীতি করা হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ অনেকে বিশেষত যারা পাকিস্তানি শাসন দেখেনি, শেখ হাসিনা সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একাকার করে ফেলেছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ও ঘোষিত চেতনা হচ্ছে গণতন্ত্র, ন্যায্যতা ও মানবিক মর্যাদা। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যহীনতার দাবিতে যেভাবে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ দল-মত নির্বিশেষে রাজপথে নেমে এসেছিল, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা সেটাই।

অন্যরা যা-ই বলুন, আমরা অনেকে আগে থেকে জানতাম, শেখ হাসিনা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতেন, সেটা প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। আমি অনেকবারই বলেছি, জবরদস্তির এ শাসন টিকবে না। অন্য ভাষায়, কেউ না কেউ এসে অন্তঃসারশূন্য এ শাসনের ‘রিসেট বাটন’ টিপে দিতে পারে।

অনেকে জানেন, ২০১২ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে প্রদত্ত একটি স্মারক বক্তৃতায় আমিই বাংলাদেশে প্রথম শেখ হাসিনাকে ‘নির্বাচিত একনায়ক’ আখ্যা দিয়েছিলাম। আর গত সাড়ে ১৫ বছরে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও তাঁর একনায়কত্ব গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

শেখ হাসিনা প্রধানত উন্নয়ন-প্রকল্পের নামে পুঁজি লুণ্ঠনকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এসবের ভয়াবহ কাহিনি তাঁর পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে।

এ প্রেক্ষাপটে ‘প্রকৃত রিসেট বাটন’ পুশ করার বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে পচা-গলা ও গণতন্ত্রহীন লুটপাটতন্ত্রকে মুছে ফেলে নতুনভাবে জাতিকে পথ চলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্ভবত সেই রিসেট বাটন পুশ করার কথাই বলেছেন। তাঁর প্রেস উইংয়ের ব্যাখ্যাও সেটা বলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি তাতে সফল হবেন? মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা যদি সমুন্নত রাখা যায়, তাহলে সেটা সম্ভব। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই এ দেশের মানুষের মধ্যে যুগ যুগ ধরে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জ্বালিয়ে রেখেছে।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular