নিউজ ডেস্ক : দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ খেলাপী প্রতিষ্ঠান সমূহের তালিকায় রয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ। গ্রুপটির কাছে রাষ্টায়ত্ব সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রুপালীসহ ১ ডজন কমার্শিয়াল ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা । বছর বছর বিশাল পরিমান সুদযুক্ত হয়ে এ টাকার অংক বৃদ্ধি পেয়ে সরকারী ব্যাংকগুলোর জন্য ক্যান্সারে রূপ ধারন করছে। বেসরকারি ব্যাংকংগুলোর জন্য অশণী সংকেত বলে মনে করছেন ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে তৈরী পোষাক কারখানার জন্য রাষ্টায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে ৯২ লাখ টাকার ক্যাপিটাল মেশনারিজ আমদানির মাধ্যমে ব্যাংকটির সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক শুরু হয় আব্দুল কাদের মোল্লার। অক্টোবর ২০২৪ এর হিসাবে আব্দুল কাদের মোল্লার প্রতিষ্ঠিত থার্মেক্স গ্রুপের ৬ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটি পাওনা হয়েছে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। যা ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো টাকাই ক্লাসিফায়েড হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের এই ঋণ আদায়ে কোন তৎপরতা নেই গ্রুপটির এমনই জানিয়েছেন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠার প্রথম যুগে থার্মেক্স গ্রুপ সফলতার চুড়ায় পৌঁছায় একটি আদর্শিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত ছিলো। ২০১০ সালের পর আব্দুল কাদের মোল্লা অপরিকল্পিতভাবে বাড়াতে থাকেন নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ সকল প্রতিষ্ঠান লুপে নিয়ে বিশাল অংকের বিনিয়োগ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। একে একে প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ও বিনিয়োগ বাড়লেও আনুপাতিক হারে বাড়েনি আমদানী- রফতানী বানিজ্য। শতভাগ রপ্তানিমূখী এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি – রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য সফল না হওয়ায় থার্মেক্স গ্রুপের ব্যাংকগুলোতে লোন লায়াবিলিটি বেড়েছে গাণিতিক হারে। এ ছাড়া আমদানী-রপ্তানী সূচক নিম্নমূখীতা, ঋণ প্রবাহের সাথে আমদানি-রপ্তানি বানিজ্যে অসমতা এবং এক্সপোর্ট প্রসিডেও ব্যাংকিং বিধি-বিধান পরিপালিত না হওয়ায় ফোর্স লোন সৃষ্টি করতে হয়েছে কয়েকটি ব্যাংককে। ফোর্স লোনগুলোও যথারীতি পরিশোধে থার্মেক্স সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক যথার্থভাবে রক্ষা করে নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। ব্যাংকারদের কেউ কেউ বলেছেন গত এক যুগ ধরে থার্মেক্সের ব্যবসার গতি-প্রকৃতি, ঋণের পরিমাণ, আমদানি-রপ্তানির আনুপাতিক অবস্থার সার্বিক বিবেচনায় সরকারী ব্যাংকগুলোতে ঋণ পরিশোধের ধারা অনিয়মিত। এ পরিস্থিতিতে সরকারী ব্যাংকগুলো থেকে ভবিষ্যৎ সহায়তা পাওয়ার কোন পথও খোলা রাখেন নি থার্মেক্স।
আইনী ফাকঁ ফোকর বের করে কোর্টের মাধ্যমে এর মালিক আব্দুল কাদের মোল্লা তার সিআইবি ক্লিন রাখার কৌশল অবলম্বন করে টিকে আছেন। এটিকে কোন দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান মনে করছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে সামনের দিনগুলোতে ব্যবসায়িক ভাবেই টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। এর বিকল্প কোন পথ নেই বলে জানিয়েছেন রুপালী, সোনালী, জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়িক পথে যদি না হাটে ব্যাংকও লোন আদায়ের বিকল্প পথ বের করে নিতে বাধ্য হবে।
কয়েকজন ব্যাংকার জানান, প্রতিষ্ঠাটিকে অনেক ছাড় দিয়েও রেগুলার রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। থার্মেক্স সে সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কতৃপক্ষ বিধি-বিধান লংঘন করে এ প্রতিষ্ঠানটিকে অতিমাত্রা সুযোগ দেয়ায় সরকারী ব্যাংকগুলো আরো বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ কারনে ব্যাংক লোন আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর দায়ীত্বশীল কর্তা ব্যাক্তিরা এ দায় কোন ভাবে এড়িয়ে যেতে পারেন না।
এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির মালিক আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর পর দুইজন গভর্নরের সাথে ছিলো সুসম্পর্ক। তিনি যেভাবে চাইতেন সেভাবেই গভর্নরদ্বয় তার লোন নিয়মিত রাখার পথ করে দিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের এই দুইজন গভর্নরের অযাচিত হস্তক্ষেপও লোন দানকারী ব্যাংক সমূহকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে করেন অনেকে।
নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার পাঁচকান্দি গ্রামের আব্দুল মজিদ মোল্লা ও নূরজাহান বেগমের পুত্র আব্দুল কাদির মোল্লা। তিনি ১৯৬১ সালের ৮ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে ৮ম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় তার বাবার মৃত্যু হলে সংকটাপন্ন পারিবারিক অবস্থার মধ্যেও এসএসসি পাশ করেন। এসএসসি পাশের পর রিক্তহস্তে ভাগ্যান্বেষণে বের হওয়া আব্দুল কাদের মোল্লা স্টাইফেন নিয়ে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি থেকে ডিপ্লোমা শেষ করেন।
এরপর সিংগাপুরে পাচ বছর একটি শিপইয়ার্ডে চাকুরী করে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৫ সালে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে ছোট একটি পদে চাকুরী নেন। সেখানে বারো বছর চাকুরী শেষে ‘৯৭ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। তিতাস গ্যাসের চাকুরী কালীন সময়ে আব্দুল কাদির মোল্লা অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জন করেন বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ। ইংরেজী দৈনিক ডেইলী স্টারসহ কয়েকটি পত্রিকায় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিতাসের সাবেক এই ৪ হাজার টাকা বেতনের বিক্রয় সহকারী কাদের মোল্লাকে নিয়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন সমূহে বলা হয়েছে, টাক্সফোর্স ২১ শত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার। রহস্যজনক কারণে ঐ তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি। তখন বিষয়টি ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিচক্ষণ কাদের মোল্লা তিতাসে মাত্র ১২ বছরের চাকুরী জীবনে বিপুল সম্পদ অর্জন বিপদের কারন হতে পারে আচ করতে পারেন। ১৯৯৭ সালে চাকুরী ছেড়ে শিল্প উদ্যোক্তা হন। এরপর এক যুগের সফলতায় আব্দুল কাদের মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপ। থার্মেক্স গ্রুপের অধীনে রয়েছে বর্তমানে ষোলটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়িক জীবনে তিনি হয়েছেন একটি বীমা কোম্পানির পরিচালক ও এসবিইসি ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান। হয়েছেন কর বাহাদুর, পেয়েছেন মাদার তেরেসাঁ পুরস্কারও। দেশ ব্যাপী জন কল্যাণ ও শিক্ষা বিস্তারে যশ – খ্যাতি রয়েছে তার। নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্খনে বহু স্কুল-কলেজ- মাদ্রাসা, মসজিদ ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কয়েক শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার দেয়া এফডিআর রয়েছে বলেও জানা যায়। এছাড়া দেশের উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ব্যাপক সাহায্য সহযোগীতা করেছেন তিনি। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করে দিয়েছেন হল বা মসজিদ, কোন বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করে দিয়েছেন কনভেনশন সেন্টার আবার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছেন পরিবহন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনকল্যাণে, শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত দেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ঋণ খেলাপীদের একজন শিল্পপতি এই আব্দুল কাদের মোল্লা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে থার্মেক্স গ্রুপের বিনিয়োগ ট্রেন্ড শুরু হয় ২০১০ সালের পর। এই ব্যাংকগুলোরও কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে থার্মেক্সে। এ সকল ব্যাংকের সরকারী ব্যাংকগুলোতে গ্রুপটির থাকা বিনিয়োগের মান ও বানিজ্যিক শিষ্টাচার, আমদানি রপ্তানি সূচকের ভারসাম্যতা ও আরো কঠোরভাবে যাচাই বাছাই করে নেয়া আবশ্যক ছিলো বলেও মনে করছেন ব্যাংক খাতের কয়েকজন বিশ্লেষক। তারা মনে করছেন, কোনভাবে একটি ব্যাংক আটকে গেলে সবগুলো ব্যাংকেরই অবস্থা খারাপের দিকে যাবে। এ ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা থাকা আবশ্যক ছিলো। বরং সতর্কতা অবলম্বন না করে পরপর দুইজন গভর্নর ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার রহস্য জনকভাবে উদার হস্তে সহযোগীতা করেছেন বলে জানা যায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সব ব্যাংক মিলে শুধু থারমেক্স গ্রুপের অধিনে থাকা প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক থেকে। এছাড়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), ডাচ-বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়াসহ দেশী ও বিদেশী কয়েকটি ব্যাংক থেকেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে থারমেক্স গ্রুপ। এর বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন একাধিক সূত্র।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপির ব্যাংক পরিচালক হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ বিভিন্ন ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়ে পড়লেও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের (এসবিএসি) পরিচালক ও চেয়ারম্যানও হয়েছেন থার্মেক্সের মালিক আবদুল কাদির মোল্লা।
থারমেক্স গ্রুপকে দেয়া ঋণের বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুরুর প্রথম দশকে স্বাভাবিক গতিতেই অগ্রসর হয়েছে থারমেক্স গ্রুপ। এ সময়ে গ্রুপটির ব্যাংক ঋণ ও ব্যবসায়িক টার্নওভার ছিলো সমান্তরালভাবে। বেশ সুনামের সাথেই ব্যবসা পরিচালনা করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তার এই সুনামের ফলে সর্বোচ্চ সুবিধাও দিয়েছিল ব্যাংকগুলো।
২০১০ সালের পর থেকে থারমেক্স এর ব্যাবসায়িক গতিবিধির পরিবর্তন শুরু হতে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকসহ অন্য আরো কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিতে থাকেন আবদুল কাদির মোল্লা। বাড়াতে থাকেন থারমেক্স গ্রুপের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। তৈরি পোশাক রফতানির পাশাপাশি টেক্সটাইল, সুতা, ডেনিম, ওভেনসহ বিভিন্ন খাতে সম্প্রসারিত হয় তার ব্যবসা। এক প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধন হিসেবে নেয়া ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করেন অন্য প্রতিষ্ঠানে। এভাবেই গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠান সমূহ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যবসার আকারের তুলনায় ব্যাংক ঋণের পরিমাণ এতই বেড়েছে যে এখন ঋণের বোঝায় লেজেগোবরে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে ধীরে ধীরে খাদের কিনারে গিয়ে দাড়িয়েছে।
এদিকে, ২০১৯ সালে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দুর্যোগ বয়ে আনলেও থারমেক্সের জন্য তা ছিলো আশীর্বাদ স্বরুপ। করোনার কারণে বছরব্যাপী ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতি ছাড়ের এ সুযোগ পুরোদমে কাজে লাগিয়েছেন আবদুল কাদির মোল্লা। উপরি পাওনা হিসেবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে পেয়েছেন স্বল্প সুদের আরো ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা।
থারমেক্স গ্রুপকে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীসহ নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় থাকা কয়েকজন ব্যাংকার বলছেন, বাছবিচার না করে থারমেক্স গ্রুপকে ঋণ দিয়ে চোরাবালিতে আটকা পড়েছেন তারা। অনেক চেষ্টা করেও এখন গ্রুপটির কাছ থেকে টাকা আদায় সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো অনাদায়ী সুদযুক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে থারমেক্স গ্রুপের ঋণের পরিমাণ। চাপে পড়তে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
থারমেক্স গ্রুপ মূলত রফতানিমুখী শিল্প হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ রফতানিমুখী বস্ত্র শিল্পের। গ্রুপটির প্রচ্ছন্ন রফতানি টার্নওভারের পাওয়া একটি ওই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তিন বছরের মধ্যে কোনো বছরেই থারমেক্স গ্রুপের সুতা ও কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রফতানি টার্নওভার ১৩ কোটি ডলার বা ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি ছিল না।
রফতানি নীতি ২০১৮-২১ অনুযায়ী, রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ রফতানি করতে হবে। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ পণ্যের শুল্ক ও কর পরিশোধ সাপেক্ষে স্থানীয় বাজারে বাজারজাতের সুযোগ রয়েছে। সে হিসাবে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার রফতানির বিপরীতে ২৭৩ কোটি টাকার বেশি পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ নেই থারমেক্সের।
থারমেক্স গ্রুপের পণ্য রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে দুই বছর ধরে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে থারমেক্স গ্রুপের সুতা উৎপাদন ও ডায়িংয়ের পাঁচটি কারখানা ইউনিট থেকে সুতার প্রচ্ছন্ন রফতানি হয় প্রায় ৫ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের। এর পরের বছর ২০১৯ সালে ওই পাঁচটি ইউনিটে উৎপাদিত সুতা রফতানি হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। রফতানির নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে বিগত ৪ বছরও।লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। মূলত ঋণপত্রের দায় সমন্বয় না হওয়ার কারণে ফোর্সড লোন সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা গ্রুপটির ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
থারমেক্স গ্রুপের কাছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক জনতার। এ ঋণ আদায় নিয়েও বিপদে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি। যদিও প্রণোদনা হিসেবে গ্রুপটিকে আরো ৪৭ কোটি টাকা দিতে হয়েছে ব্যাংকটিকে।
আবদুল কাদির মোল্লার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ আছে ৭০০ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের ৩৫০ কোটি টাকার মতো। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় প্রতিনিয়ত এ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আবার প্রণোদনা হিসেবে থারমেক্সকে ৫৭ কোটি টাকা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। রূপালী ব্যাংক থেকেও পেয়েছে ৫২ কোটি টাকা।
থারমেক্স গ্রুপের ঋণের লাগাম টেনে ধরছেন বলে জানিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ একে কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গ্রুপটির ব্যবসা এতদিন সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন সময় এসেছে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার। থারমেক্সকে এখন রফতানির মাধ্যমে দায় সমন্বয় করতে হবে। আমরা নতুন আর কোনো ঋণ দিচ্ছি না। আশা করছি, গ্রুপটি ব্যবসায়িক ভাবে ঘুরে দাঁড়াবে।
অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা একই ভাবে বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে। এখন ভালো গ্রাহকরাও ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে চাইছেন না। সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করা উদ্যোক্তারাও ইচ্ছেকৃত খেলাপির তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। এভাবে চলতে দেয়া যায় না।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মতোই আবদুল কাদির মোল্লার প্রতিষ্ঠান গুলোকে দেয়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ দুর্দশাগ্রস্তের তালিকায় উঠে আসতে শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক চাপের কারণে বারবার পুনঃতফসিল করতে হয়েছে এ ব্যাংকগুলোর ঋণও। ঋণগুলো অনাদায়ী সুদ যুক্ত হওয়ায় প্রতিনিয়ত গ্রুপটির কাছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গ্রুপটিকে নিয়ে নিজেদের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের কথা জানালেও এ ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা নিজেদের নাম উদ্ধত করে ঋণগুলো অনাদায়ী সুদ যুক্ত হওয়ায় প্রতিনিয়ত গ্রুপটির কাছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গ্রুপটিকে নিয়ে নিজেদের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের কথা জানালেও এ ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা নিজেদের নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে চাননি।
বড় একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, পাঁচ বছর ধরেই থারমেক্সের ঋণ নিয়ে বিপদে আছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে তথা মন্দ মানের খেলাপি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা আবদুল কাদির মোল্লার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে তিনি সুযোগের শতভাগ সদ্ব্যবহার করছেন।
অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে কোনো ঋণ নেননি বলে আবদুল কাদির মোল্লা প্রায়ই গর্ব করেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান করার অর্থ তিনি কোথায় পেলেন, তার জবাব নেই। মূলত এক প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া চলতি মূলধনের অর্থ ডাইভার্ট করে অন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। এ কারণেই গ্রুপটির বিপর্যয় বেড়েছে।
থারমেক্স গ্রুপকে নতুন করে ঋণ না দেয়ার নীতি নিয়েছে এর আগে ঋণ দেয়া সরকারী ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি গ্রুপটির সঙ্গে ব্যবসা গুটানোর চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কেউ কেউ। জানা যায় ব্যবসায় কোনো ক্ষতি বা রপ্তানি কখনোই বন্ধ ছিলনা। তথাপিও মালিক ঋন পরিশোধ করছেন না। তাই বুঝা যায় মোল্লা একজন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। তার বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়ার উপযুক্ত সময়।
তার সিএসআরের কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যাংকার বলেন, ব্যাংককে ঝুঁকিতে রেখে এ ধরনের কাজ “রাতে ডাকাতী আর দিনে উদার হস্তে দান করার সামিল। এর বেশী কিছু নয়”।
সার্বিক বিষয়ে জানতে আব্দুল কাদের মোল্লাকে তার অফিসিয়াল মোবাইল নাম্বারে কল করা হলে, তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। বার বার কল করেও তার মোবাইল নাম্বার খোলা পাওয়া যায়নি।