ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeসারাদেশনীলফামারীহারিয়ে যাচ্ছে নীলফামারীর প্রিয় খাবার সিঁদল

হারিয়ে যাচ্ছে নীলফামারীর প্রিয় খাবার সিঁদল

নীলফামারী প্রতিনিধি : নীলফামারীর জনপ্রিয় খাবার সিঁদুল। ঘরে জনপ্রিয় এই খাবার। সিঁদলের কথা শুনলে জিভে জল আসে। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের আকাল, নারীদের কর্মব্যস্ততা এবং বাহারি খাবারের ভিড়ে সিঁদল ভর্তা বা তরকারি গ্রামের মানুষের খাবারের পাতে আর দেখা যায় না। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সিঁদলের কদর যথেষ্ট। সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও প্রচুর স্বাদের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের এটি একটি প্রিয় খাবার।
পারিবারিক অনুষ্ঠানে, নতুন জামাইয়ের বাড়িতে পাঠানো কিংবা মেহমানদারির ক্ষেত্রে এক সময় সিঁদল ছিল অন্যতম একটি খাবার। এছাড়াও লাপা শাকের পেলকা এ অঞ্চলের মানুষের একটি অন্যতম প্রিয় খাবার। সিঁদলের সাথে পেলকা হলে তো কথাই নাই।
দিন বদলের সাথে দেশীয় ছোট মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। ছোট মাছ সিঁদলের প্রধান উপকরন। এখন আর চোখে পড়ে না সিঁদল তৈরি করতে নারীদের ব্যস্ততা। হাটে-বাজারে বিক্রিও হয় না। তবে সচরাচর দেখা না হলেও মাঝেমধ্যে পাড়ার দু,একটি বাড়ীতে দেখা মেলে। শখের বশে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি এখনো তৈরি করেন।
সিদল তৈরি করতে লাগে, মলা মাছ, ঢেলা মাছ, দাইরকা মাছ, বুনচুকা মাছ, খৈলসা, ছোট টাঁকি মাছ ও পুঁটিমাছ। এসব মাছ ভালো করে ধুয়ে ১০-১২ দিন কড়া রোদে শুকিয়ে মচমচে হলে মাছের শুঁটকিগুলো উরুন গাইন অথবা হামান দিস্তায় গুঁড়া করে নিতে হয়। এরপর বন জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা কালো কচুর ডাঁটা রোদে শুকানোর পর তা ধুয়ে নিয়ে বাটতে হয়। এরপর রসুন, আদা, মরিচ ও মসলাসহ শুঁটকি ও কচু বাটার সংমিশ্রনে তৈরি করা হয় সিঁদল।
দ্ধিতীয় ধাপে সব মেশানো হয়ে গেলে একদিন পর (দলা) মন্ডগুলো হলুদ ও সরিষার তেল দিয়ে মেখে হাত দিয়ে গোল (বল) করে ৫-৬ দিন হালকা রোদে ডালা বা কুলায় জাল দিয়ে ঢেকে শুকিয়ে একটু শক্ত হলে খাবার উপযোগি হয়। পরে চুলার ছাই দিয়ে শুকনো পাতিলে সংরক্ষণ করতে হয়।
সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের কারণে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে এটি অতি জনপ্রিয়। এছাড়াও পরিবার থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়নে সিঁদল ভর্তার জুড়ি নেই। অনেকেই টাঁকি মাছ, সোল মাছ, কাতলা মাছ, বোয়াল মাছ ও ইলিশ মাছের সাথে রান্না করে মেহমানদের খেতে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, হাটে-বাজারে বিক্রিও হতো গ্রামীণ নারীদের হাতের তৈরি সিঁদল।
সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের বাহালী পাড়া গ্রামের অজিফা বেগম (৭৪) জানান, ‘কালা কচুবাটার সঙ্গে খৈলসা, দাইরকা, পুঁটি মাছের শুঁটকি গুড়া, পছন্দমত শুকনা মরিচ, রসুন, আদা উরুন (সাম) গাইনে অথবা শিলপাটায় বেটে নিতে হয়। এরপর হলুদ গুঁড়া ও খাঁটি সরিষার তেল মাখিয়ে অল্প পরিমাণে নিয়ে হাতের তালুতে গোল করে সিঁদল বানাতে হয়। তারপর কড়া রোদে কয়েকদিন শুকিয়ে ছাই দিয়ে মাটির পাতিলে রেখে তা ধীরে ধীরে ভর্তা বা তরকারি রান্না করে খাওয়া যায়। এভাবে এক বছরের অধিক সময় রেখে খাওয়া যাবে। তবে এর স্বাদ আরও বৃদ্ধি পাবে।’
জেলার সৈয়দপুরের কথাসাহিত্যিক ও সৈয়দপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, আগের মতো খাল, বিল, নদী-নালা, পুকুর ও ডোবা নাই। তাই ছোট মাছ পাওয়া যায় না। এখন মানুষ খাল বিল ভরাট করে আবাদী জমি, ঘর বাড়িসহ কলকারখানা ও কোম্পানি তৈরি করছে। পুকুর না থাকায় মাছও দেখা যায় না। এখন মাছও নাই সিঁদলও নাই। মায়ের হাতের সিঁদুলের ভর্তা, লাপা শাকের পেলকা আর গরম ভাত চাটি পুটি খাছিনো। সেদিন গেলো কোনঠে (কোথায়)।
জেলা শহরের নিউবাবুপাড়ার বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, ‘২০ বছর আগে এ অঞ্চলে খাল-বিল নদী-নালায় প্রচুর দেশি প্রজাতির ছোট-বড় মাছ পাওয়া যেত। তখন সিদল তৈরি করাটা অনেকের পেশা ছিল। হাট বাজারে সিদল বিক্রির ধুম পড়ে যেত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের বিবর্তনে মাছের সংকট হওয়ায় সিঁদল হারিয়ে যেতে বসেছে।’
সৈয়দপুর উপজেলার বোতলাগাড়ি ইউনিয়নের আলিফা বেগম জানান, আগে আমাদের বাড়িতে আত্বীয়-স্বজন এলে সিদলের ভর্তার বাটি থাকতেই হবে। শোল, বোয়াল ও কাতলা মাছের সাথে সিঁদল মিশিয়ে একটু বেশি ঝাল ঝাল করে রান্না করা হতো। খেতে খুবেই মজাদার হতো। এখন মাছের অভাবে সিঁদল হারিয়ে যাচ্ছে।’
ঐতিহ্যবাহী সিঁদুল কে ধরে রাখতে অনলাইনে সিঁদুলের ব্যবসা শুরু হয়েছে। অনেক নারী-পুরুষ এই সিঁদল তৈরি করে বিক্রি করে ভালো টাকা রোজগার করছেন। দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে এই ব্যবসা বলে জানান সৈয়দপুর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠাতা ও সৈয়দপুর মহিলা কলেজের প্রভাষক শিউলি বেগম।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular