ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeআলোকিত মুখগণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

নিউজ ডেস্ক: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালে ব্রিটিশ ভারতের মেদিনীপুরে এক শিক্ষিত ও প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং তার বড় ভাই শাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসক। সোহরাওয়ার্দীর মা খুজিস্তানের বিখ্যাত জমিদার পরিবারের মেয়ে ছিলেন। পারিবারিকভাবে তারা শিক্ষিত ও প্রভাবশালী ছিলেন, যা তার শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছিল।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, যেখানে তিনি আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯২০ সালে ইংল্যান্ডের গ্রে’স ইন থেকে বার অ্যাট ল’ সম্পন্ন করেন এবং কলকাতায় আইন পেশায় যোগ দেন।

গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও মানুষের কল্যাণে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন ও আদর্শ আমাদের সবসময় সাহস ও প্রেরণা জোগায়। জাতি এই মহান নেতার অবদান সবসময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপমহাদেশের মেহনতি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষকে সোচ্চার ও সংগঠিত করেছিলেন। একজন প্রতিভাবান রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তাঁর দক্ষ পরিচালনায় সুযোগ্য উত্তরসূরী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন উদার ও প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রীসহ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃত। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম মমত্ববোধ।মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকাশ এবং এ অঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সারাজীবন কাজ করেছেন। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবক।বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে অবিভক্ত এবং স্বাধীন বাংলার ধারণার প্রস্তাব তুলে ধরেন। বাংলা, আসাম ও বিহার অঞ্চলের কয়েকটি জেলা নিয়ে ‘বৃহৎ বাংলা’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর।

রাজনৈতিক জীবন: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে। তিনি প্রথমে কংগ্রেস পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। তবে ১৯৩০-এর দশকে তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে থাকেন। তিনি মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৪৬ সালের গণহত্যা ও কলকাতা দাঙ্গা: ১৯৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ সময় কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যা “কলকাতা দাঙ্গা” নামে পরিচিত। সোহরাওয়ার্দীর সরকার দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে তাকে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। যদিও দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করেন, তবুও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই দাঙ্গা একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক অবদান: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কাজ করেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা পালন করেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব: ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ নেন। তবে সামরিক ও রাজনৈতিক চাপে তার সরকার ১৯৫৭ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা: সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত হন এবং কারাবরণ করেন। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় হন এবং জনগণের জন্য কাজ করে যান।

তার রাজনৈতিক আদর্শ এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অমর ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সোহরাওয়ার্দী বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে গেছেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উত্তরাধিকার: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উত্তরাধিকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তার স্মরণে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করা হয়েছে, যা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণার ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেক বিতর্ক রয়েছে, কারণ অনেকের ধারণা এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা ছিল। তবে তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও অজানা।

সম্পাদনা: লতিফুল বারী হামিম

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular