মোহাম্মদ ইউনুছ অভি, টেকনাফ কক্সবাজার: রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার সাত বছর পূর্ণ হবে রবিবার (২৫ আগস্ট)। কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল মিয়ানমার সরকার। কিন্তু সেই প্রত্যাবাসন আজো শুরু হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে করছে দুই পক্ষেই। এতে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে বহু রোহিঙ্গা। আর যারা প্রাণে বেঁচে আছেন তাঁরাই নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকে পরছে। এতে আরো চাপ-বিপদ বাড়ছে বাংলাদেশে।
তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত-নাফনদে আমরা টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে উল্লেখ করে টেকনাফের-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'নতুন করে আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। ইতি মধ্য আমরা বহু অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করেছি।’
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ‘রাখাইনে আরাকান আর্মি ও জান্ত সরকার (সশস্ত্র বাহিনী) তাদের যুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে রোহিঙ্গাদের। মূলত রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শূন্য করতে তাদের এই কৌশল। ইতি মধ্য বহু রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। এখনো প্রাণে বাচঁতে মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে বহু রোহিঙ্গা। ইতি মধ্য অনেকে ক্যাম্প আশ্রয় নিয়েছে। ফলে ক্যাম্পেও চাপ-অস্বিরতা বাড়ছে। এছাড়া নাফনদী-সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে। ইতি মধ্য চলতি মাসে প্রায় ২০০ মানুষের লাশ উদ্ধার করে এ কূলে দাফন করা হয়েছে।
কক্সবাজারের এনজিও কর্মী মাহবুব আলম মিনার বলেন, ‘রাখাইনে জান্তা সরকার ও আরকান আর্মির মধ্য যুদ্ধেরে কারনে মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। অনেকে প্রাণে বাচঁতে সাগর-নাফনদী পাড়ি দিচ্ছে। এতে অনেকে নৌকা ডুবেও মারা যাচ্ছে। চলতি মাসে অন্তত উখিয়া-টেকনাফের সাগর ও নাফনদীতে ভেসে আসা প্রায় ২০০ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করে দাফন দেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, আবার অনেকে ক্যাম্পে আশ্রয়ও নিয়েছে। এতে ক্যাম্পে চাপ ও অস্বিরতা বাড়ছে। এভাবে চলতে বাংলাদেশে আরো বিপদ বাড়বে। এসব বিষয়ে একমাত্র সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন।’
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া আর টেকনাফ উপজেলায় এখন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বাস। দুই উপজেলায় মোট স্থানীয় পাঁচ লাখের মতো। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সেখানে এখন সংখ্যালঘু। আর অবনতি ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও। আর ক্যাম্পে ঘটছে মাদক, হত্যা, অপহরণ ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধ। মিয়ানমারে সামারিক নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। তখন তাদের সংখ্যা সাত লাখের মতো হলেও এখন সংখ্যাটা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তবে ইউএনএইচসিআরের হিসেবে এখন কক্সবাজারের ২৭টি ক্যাম্প এবং ভাসানচরে মোট নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন ৯ লাখ ৫০ হাজার ৯৭২ জন। আরো এক লাখ রোহিঙ্গা শিশু এখন নিবন্ধনের অপেক্ষায়। এর বাইরেও আগে আসা নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছেন প্রায় ৪০ হাজার।
গত কয়েক দিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে। এতে মর্টারশে-গুলিতে বহু রোহিঙ্গা প্রাণ হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার ও আরকান আর্মি তাদের চলমান যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যার ফলে প্রতিদিন সেদেশে রোহিঙ্গার মৃত্যু খবর পাচ্ছি আমরা। আবার অনেকে প্রাণে বাচঁতে ক্যাম্পেও আশ্রয় নিচ্ছে। এতে ক্যাম্পে চাপ এবং অস্তিরতা বাড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইতি মধ্য রাখাইনের অনেক রোহিঙ্গা গ্রাম খালি হয়ে গেছে। অন্তত নতুন করে দশ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের খবর আমরা পেয়েছি। যারা অনেকে ক্যাম্পে আগে থেকে থাকা স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া আবার অনেকে গ্রামে মধ্য থাকছে। তবে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে প্রাণে বাচঁতে পালাতে গিয়ে অনেকে নাফনদী ও সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছেন। এরপরও আমরা বাংলাদেশে আর বোঝা হয়ে থাকতে চায় না। আমরা রাখাইনে ‘সেফজোন’ ফেলে নিজ দেশে ফিরে যাবো। এছাড়া কাল সাত বছর উপলক্ষে নিজ দেশে ফেরত যেতে আমাদের দাবির বিষয়ে ক্যাম্পে একটি সভা আয়োজন করা হয়েছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্যমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্র্যাবাসন শুরর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল ২০২৩ সালের মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর মে মাসে রাখাইন পরিস্থিতি দেখতে যান রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ২৭ ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর হলেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা হয়নি।
উখিয়ার কুতুপালংয়ের ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘ক্যাম্পে দীর্ঘ সাত বছর পার হয়ে গেলো। এখনো নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেনি। তার উপর বাংলাদেশে নতুন করে আরও রোহিঙ্গা ঢুকছে। এতে ক্যাম্পে অস্বিরতা বাড়বে। এ নিয়ে খুবিই চিন্তিত। আমাদের ভবিষ্যত কোন দিকে যাচ্ছে?।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে প্রত্যাবাসনের কোনও বিকল্প নেই উল্লেখ করে কক্সবাজারের অতিরিক্তি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামসু-দৌজা বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার সব সময় প্রস্তুত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে। রোহিঙ্গারা রাখাইনে নিজেদের ভিটে বাড়িতে যেতে চায়। তবে তাদের নিরাপত্তা এবং নাগরিকত্বের দাবিও রয়েছে। আমাদের চেষ্টা রয়েছে দ্রæত কিভাবে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়। না হলে সামনে আমাদের চাপ ও বিপদ বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সাত বছরের উপলক্ষে ক্যাম্পের রবিবার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। সেখানে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে দাবিগুলো তুলে ধরবেন।;
ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ
আপনার মতামত লিখুন: