
হারুন হাবীব
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সি আর দত্ত (চিত্তরঞ্জন দত্ত) বীরউত্তম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক। গত বছরের এই দিনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় একটি হাসপাতালে পরলোকগমন করেন। তিনি ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক ভিটা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে।
তার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে স্থায়ী বসবাস শুরু করলে তিনি হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর কিছুদিনের জন্য আবার কলকাতার আশুতোষ বিজ্ঞান কলেজে লেখাপড়া করলেও শেষ পর্যন্ত বিএসসি পাস করেন খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে।
১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান। তার সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধ (পাকিস্তান-ভারত) করেন পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর চূড়ান্ত মুহূর্তে ছুটিতে দেশে ছিলেন সি আর দত্ত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দায়িত্ব পান ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে। আমার নিজের রণাঙ্গন ছিল ১১ নম্বর সেক্টর। তাই মুক্তিযুদ্ধ পর্বে রণাঙ্গনে তার সঙ্গে লড়াই করার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তীকালে বিশেষ করে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের গঠন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার সুবাদে তাকে জানার বিশেষ সুযোগ ঘটে।
২০০১ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মুক্তিযুদ্ধের রক্তার্জিত মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আঘাত করতে থাকে পরিকল্পিত উদ্যোগে। ২০০৪-০৫ সালের দিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সরাসরি আক্রমণ করতে থাকে। সরকারের সহযোগী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা ওই সময়ে আস্ম্ফালন শুরু করে। বলতে থাকে দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, হয়েছে 'গৃহযুদ্ধ' মাত্র এবং সে কারণে কোনো 'যুদ্ধাপরাধী' থাকার সুযোগ নেই দেশে !
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় সব সেক্টর কমান্ডারের এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন। ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ম্ফালনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়করা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের ডাক দেন। ওই সম্মেলন থেকেই অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে জাতীয় দাবিতে পরিণত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়। দ্রুত গড়ে ওঠে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ '৭১।
মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা তখন বহু দলমতে বিভক্ত। ওই বিভক্তির সুযোগ সৃষ্টি করে '৭৫-পরবর্তী সামরিক ও আধা সামরিক শাসন, যারা পরিকল্পিত উপায়ে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে চলছিল। কিন্তু সেই চলমান বিভাজন সত্ত্বেও একাত্তরের সমর অধিনায়করা তাদের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ থেকে দূরে সরে থাকেননি।
সময়ের দাবিতে জাতীয় সমরের বীরউত্তম অধিনায়করা একে অপরের হাতে হাত মেলান। একমঞ্চে দাঁড়ান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল সি আর দত্ত, কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, লে. জেনারেল মীর শওকত আলী, কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী এবং মেজর রফিকুল ইসলাম। গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী সমরনায়কদের এক দৃঢ় ঐক্য।
যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবি দ্রুত জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ওই জাগরণের ব্যাপক প্রভাব পড়ে ২০০৯-এর সাধারণ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধপন্থি সম্মিলিত রাজনৈতিক শক্তি ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ আন্দোলনের সেই পর্বে যুক্ত থাকার সুবাদে জেনারেল সি আর দত্তসহ অন্য সব সেক্টর কমান্ডারকে কাছ থেকে জানার সুযোগ তৈরি হয় আমার।
দৃঢ়চিত্ত অথচ অমায়িক স্বভাবের ছিলেন জেনারেল দত্ত। তার দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা এবং সাহসী উচ্চারণ আকৃষ্ট করে মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধের পর জেনারেল দত্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তারই হাতে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস অর্থাৎ, ইপিআর পরিণত হয় বাংলাদেশ রাইফেলসে। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচালিত হয়েছে তারই নেতৃত্বে। ওই সময়ই জেনেছি, তার নেতৃত্বে এসব জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিস্তৃতও হয়।
অসাংবিধানিক ও সাম্প্রদায়িক শাসনের বেড়াজালে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যখন প্রবলভাবে আক্রান্ত ও শঙ্কিত, জেনারেল সি আর দত্তও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তবে বসে থাকেননি। তারই নেতৃত্বে গড়ে ওঠে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। দাবি তোলা হয় অমানবিক ও অসাংবিধানিক 'শত্রু সম্পত্তি' বা 'অর্পিত সম্পত্তি' আইনটি বাতিলের। ফলে উগ্রপন্থিদের প্রবল আক্রমণের শিকার হতে হয় জেনারেল সি আর দত্তকে।
নানা সমালোচনা ও আক্রমণের পরও পিছিয়ে আসেননি তিনি, বরং মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। অশেষ শ্রদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের এই সমরনায়ককে।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: