মাহবুব উল্লাহ
বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে উঠতে পারে- এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন কিছু কিছু অর্থনীতিবিদ এবং গণমাধ্যম। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে কিনা, তা নিয়ে চলছে তর্কবিতর্ক। এ ধরনের তর্কবিতর্ক চলতে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। অর্থনীতি কোন পথে চললে সংকট সৃষ্টি হবে না, তার জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত নীতিমালা গ্রহণের পরামর্শ। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে মিলগুলো কী এবং অমিলগুলোই বা কী, সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা উন্নয়নের দিক থেকে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছিল। শ্রীলঙ্কা শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করেছিল। দেশটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কায় মোটা দাগে উন্নয়নের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। দেশটি সাক্ষরতার দিক থেকে চমৎকার সাফল্য অর্জন করার ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং পরিবার পরিকল্পনার দিক থেকেও চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন অর্জনে শ্রীলঙ্কা মারাত্মক একটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা তিনটি জাতিগোষ্ঠীর দেশ। এগুলো হচ্ছে সিংহলি, তামিল এবং মুসলিম। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর দেশটি জাতিগত সমস্যার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতাউত্তরকালে জাতি গঠনে শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়নি। প্রয়োজন ছিল সব জাতিগোষ্ঠীর অভিযোগ বিবেচনায় নেওয়া। একই সঙ্গে সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের বন্ধন দৃঢ় করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। কিন্তু শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব সে পথে হাঁটেনি। শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠী উগ্র জাতীয়তার মধ্যে আচ্ছন্ন থাকায় জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে সিংহলিদের উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সঙ্গে আপস করে চলতে হয়েছিল। এর ফলে তামিলদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সশস্ত্র সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
এর ফলে দীর্ঘ এক দশক ধরে তামিলদের সঙ্গে সরকারি বাহিনী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। আজ আমরা বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের যে উন্নতি লক্ষ্য করছি, তা ছিল এই শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সমস্যা। উন্নত দেশগুলোর পোশাকের চাহিদা মেটাতে শ্রীলঙ্কাই ছিল অন্যতম পছন্দের দেশ। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে আন্তর্জাতিক পোশাক ব্যবসার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলো শ্রীলঙ্কার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে এবং তারা বাংলাদেশমুখী হয়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকির দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হয়। এই বিবেচনা থেকেই পোশাকশিল্পের ক্রেতারা শ্রীলঙ্কা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে প্রধান খাতগুলো হচ্ছে- কৃষি, পর্যটন, চা শিল্প প্রভৃতি। আজ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে অপারগতা। দেশটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। এই বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণ এবং সুদ পরিশোধের জন্য দেশটির প্রয়োজন ৬৯০ কোটি ডলার। এরর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ২৩১ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এভাবে নেমে আসা প্রতিরোধে শ্রীলঙ্কার নীতিনির্ধারকরা প্রয়োজনীয় নীতিকৌশল গ্রহণ করেননি। শ্রীলঙ্কা আজ হাহাকারের দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র উন্মোচিত হওয়ার আগেই মিডিয়াতে অকল্পনীয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। শ্রীলঙ্কায় কাগজের জোগান না থাকার ফলে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের ফলে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এত বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় অতীতে কখনও হয়নি। বিদ্যুতের অভাবে দিনের অর্ধেক সময় লোডশেডিং হয় শ্রীলঙ্কায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে জনগণকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। পেট্রোল পাম্পে তেল নেই; রান্নার গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। মানব উন্নয়নের দিক থেকে যে দেশটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল; সেই দেশ কীভাবে এমন বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তা গবেষণার একটি নতুন বিষয় উন্মোচিত করেছে।
শ্রীলঙ্কায় নিত্যপ্রয়োজনীয় গণ্যসামগ্রী কেনার জন্য যেভাবে ক্রেতাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সে রকম পরিস্থিতি বিরাজ করত সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে। এসব দেশে ভোক্তার চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতো না। এসব দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভারী শিল্পের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদিত হতো না। ফলে এসব পণ্যের ক্রেতাদের লাইনে দাঁড়িয়ে বিরক্তিকরভাবে অপেক্ষা করতে হতো। বলা হতো, সমাজতান্ত্রিক দেশে মূল্যস্ম্ফীতি হয় না। জিনিসপত্র সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করা হতো বলে মূল্যস্ম্ফীতি হয় না- দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদরা দাবি করতেন, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও মূল্যস্ম্ফীতি হয়। ভোক্তার চাহিদা অপূর্ণ থাকাই মূল্যস্ম্ফীতি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় যে হারে মূল্যস্ম্ফীতি ঘটছে, তার জন্য দায়ী বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে না পারা। অতীতের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক কাঠামো একদিকে হেলে পড়ার ফলে লুক্কায়িত মূল্যস্ম্ফীতি হতো।
শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে সমস্যাটির মূলে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে না পারা। শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ম্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ এবং শ্রীলঙ্কার মোট জিডিপির অনুপাত ১১৯ শতাংশ। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় যা কিছু উৎপাদিত হয় এক বছরে, তার মূল্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। জিডিপি যদি আরও ১৯ শতাংশ বাড়ানো যেত তাহলে এই ঋণের অঙ্কটি সমান সমান হারে পরিশোধ করা যেত। সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যের কিছু দেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এসব দেশের মধ্যে গ্রিসের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ায় নতুন করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ পাচ্ছে না। ঋণদাতারা শ্রীলঙ্কার ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নোট ছাপিয়ে সমস্যার সমাধান কোনো সুফল দেয়নি। নতুন নোট ছাপানোর ফলে বল্কগ্দাহীন হয়ে পড়েছে মূল্যস্ম্ফীতি।
শ্রীলঙ্কা বিদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল হিসেবে গণ্য করা হতো। শ্রীলঙ্কার ভূপ্রাকৃতিক অবস্থা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করত। এ দেশের প্রতি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ হ্রাস পাওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার কিছু গির্জা এবং হোটেলে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণের ফলে দেশটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। বিদেশি পর্যটকরা একদিকে যেমন চমৎকার নৈসর্গ এবং ছিমছাম হোটেল পছন্দ করে; তার সঙ্গে তারা চায় জীবনের নিরাপত্তা। নতুন দেশ দেখতে গিয়ে যদি প্রাণ হারাতে হয়, তাহলে বিদেশি পর্যটক সে দেশে কেন আসবে? ২০১৯ সালে যে ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণগুলো হয়েছিল তার পেছনে যে বা যারা ছিল; আমার জানামতে সে রকম কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হতে পারে তামিলদের অবশিষ্ট শক্তি প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চেয়েছিল। শ্রীলঙ্কা নিয়ে আঞ্চলিকভাবে যে রশি টানাটানি আছে, তার মধ্য থেকেও এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। দুর্ঘটনায় ২৫০ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। এই একটি সন্ত্রাসী হামলার ফলে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে পর্যটকদের আগমন ৭১ শতাংশ হ্রাস পায়।
২০২০ থেকে কভিডের অতিমারির ফলেও শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত সংকুচিত হয়। ২০১৮ সালে পর্যটন থেকে শ্রীলঙ্কার আয় হয়েছিল ৪৪০ কোটি ডলার। ২০২০ সালে পর্যটন খাত থেকে শ্রীলঙ্কার আয় নেমে আসে ৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারে। এটি আরও হ্রাস পেয়ে ২০২১ সালে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলারে। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক শাসনে লোকরঞ্জনবাদী নীতির ফলে পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, বরং আরও অবনতি হয়। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৮ শতাংশ করেন। পণ্য পরিষেবার ওপরে যে ২ শতাংশ ন্যাশন বিল্ডিং ট্যাক্স আদায় করা হতো, তাও প্রত্যাহার করা হয়। শেয়ারবাজারের মূলধনি আয়ের ওপর করভার হ্রাস করা হয়। এসব লোকরঞ্জনবাদী পদক্ষেপের ফলে রাজকোষ শূন্য হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়।
শ্রীলঙ্কার সরকার কৃষি খাতেও বিপজ্জনক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবজনিত সমস্যা সামাল দিতে গিয়ে সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এতে কৃষকদের জৈব সারের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে কৃষি উৎপাদন ভয়াবহভাবে হ্রাস পায়। এখন পর্যন্ত বিশ্বপরিসরে পরিবেশবান্ধব কৃষির প্রচলন কোনো দেশেই নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়নি। যদি পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা চালু করতে হয় তাহলে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে পরিবেশবান্ধব কৃষিকে রাসায়নিক সারভিত্তিক কৃষির তুলনায় অধিকতর লাভজনক করে তুলতে হবে। এ রকম পরিস্থিতিতেই পরিবেশবান্ধব কৃষি অর্থনীতি চালু করা সম্ভব।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসের সরকার পরিবেশবান্ধব কৃষি নিয়ে ছেলেখেলা করতে গিয়ে শুধু কৃষিই নয়, চা শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় এক কেজি চালের দাম ২৫০ টাকা। কৃষিজাত পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির জন্য ভ্রান্ত নীতিকেই দায়ী করতে হবে। শ্রীলঙ্কায় উচ্চতর জ্ঞানসমৃদ্ধ বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। তা সত্ত্বেও সরকার কী করে এমন আত্মঘাতী নীতি গ্রহণ করল, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। অনেকে বলেন, রাজনৈতিকভাবে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রাধান্য পাওয়ায় গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থ অনুযায়ী দেশের নীতিনির্ধারণমূলক কাজগুলো হয়েছে গোষ্ঠীতন্ত্রের অনুকূলে; জনগণের স্বার্থের অনুকূলে নয়।
শ্রীলঙ্কায় বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সমুদ্রবন্দর, দেশের অভ্যন্তরে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রবাহের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা ইত্যাদি। অবকাঠামোগত স্থাপনা থেকে আয়ের উৎসরণ হয় ধীরগতিতে। অবকাঠামোর প্রত্যক্ষ আয় হলো এগুলো থেকে প্রাপ্ত টোল ও ফি। অপ্রত্যক্ষ আয় হলো অবকাঠামোগত স্থাপনা সৃষ্টির ফলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে আয় বৃদ্ধি। কিন্তু সেই আয় বৃদ্ধির জন্য লিংকেজগুলো তৈরি করা। তাহলেই কেবল অবকাঠামো থেকে পরিপূর্ণ সুফল পাওয়া সম্ভব। অবকাঠামো নির্মাণকালে বাজারে প্রচুর পরিমাণে বাড়তি তারল্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু একই সময়ে সে রকম দৃষ্টিগ্রাহ্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের হিড়িক পড়ে না। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মূল্যস্ম্ফীতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো নির্মাণ যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে; তা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন।
বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মিল হলো ২-৩টি খাতের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা। এই খাত তিনটি হলো- পোশাকশিল্প, প্রবাসী আয় এবং কৃষি। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি বহুমুখীভাবে বিকশিত হয়ে না উঠবে; ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু অপরিহার্য পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচার এখন একটি খোলামেলা বিষয়। এই পুঁজি দেশে বিনিয়োগ হয় না। পাচারকৃত পুঁজি যদি দেশে থাকত তাহলে এই পুঁজি থেকে অধিকতর আয় করার জন্যও উদ্যোগ থাকত। পুঁজি পাচার অবশ্যই একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা। অর্থনৈতিক তত্ত্ব বলে, নিরাপত্তার অভাবে পুঁজি পাচার হয়। বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচারের জন্য নিরাপত্তাহীনতাকে পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। যে দেশে বল্কগ্দাহীনভাবে কালো টাকা সৃষ্টি হয় এবং রেন্টসিকিং পদে পদে অনিবার্য হয়ে ওঠে, সে দেশ থেকে পুঁজি পাচার রোধ সত্যই কঠিন। একটি কাম্য পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন রাজনীতিবিদ এবং তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সততা। প্রশ্ন হলো- আমরা কি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার জন্য সততাকে প্রাণোদনা দিতে এবং অসততা ও দুর্নীতিকে নিবারণ করতে পারি।
ড. মাহবুব উল্লাহ, অর্থনীতিবিদ; সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: