• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

আমাদের অর্থনীতি সচল ও বিকাশমান থাকবে


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০২:১১ পিএম
সচল ও বিকাশমান থাকবে
আমাদের অর্থনীতি

মোনায়েম সরকার
কোনো দেশের অর্থনীতি সবসময় একই গতিতে চলে না। কিন্তু আমাদের দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হলেই অনেকে হতাশ হয়ে পড়েন। তাদের একাংশ এজন্য শুধু সরকারকে দোষারোপ করতে থাকে। সরকারের দোষ ধরার প্রবণতাও কম দেখা যায় না। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হতে থাকলে কিন্তু সরকারের প্রশংসা তেমন দেখা যায় না। তখন এমনও বলতে দেখা যায়, কৃষক নিজ চেষ্টায় ভালো করছে; শিল্পবাণিজ্যের লোকেরাও শুধু নিজ যোগ্যতাবলে উন্নতি লাভ করছে।

অথচ সরকারের নীতিগত সহায়তা ছাড়া কোনো খাতেই ভালো করা সম্ভব নয়, এটা সবাই জানি। সরকারের ভুল নীতিকৌশলে কোনো খাতের উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটাও বলতে হবে। কিন্তু তার মাত্রা থাকা প্রয়োজন। সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা যেন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা বলে মনে না হয়।

আমরা জানি, এ অঞ্চলের কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং তাতে অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের ভুল পদক্ষেপের দায় রয়েছে। এখানে শ্রীলঙ্কার কথা বলতে হয়। দেশটির অর্থনীতি এত সংকটে পড়ে যে, তাতে সেখানে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। তখন এদেশেও অনেকে, এমনকি অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলতে থাকেন, বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। বিরোধী রাজনৈতিক মহলেও জোরেসোরে প্রচার করা হয়, দেশ অচিরেই শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে। তাদের পক্ষে কিছু অপপ্রচারকারী দেশের বাইরে রয়েছেন। তারা প্রচার করেছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতিও শ্রীলঙ্কার ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়নি। এদেশ তার কক্ষপথেই রয়েছে। আমাদের অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই, অর্থনীতি পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই সঠিক হচ্ছে, তা অবশ্য বলা যাবে না। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ভুল হচ্ছে, এমনটাও নয়। তুলনা করে বরং বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তানের চেয়েও অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা যেমন করুণ, তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও তেমনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে তার দূরবর্তী অংশ এ ভূখন্ডের মানুষকে এখন কী দুর্গতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো, সেটা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। স্বাধীনতা অর্জনের পর, নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাও অর্জন করে চলেছে। পরপর তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনার সুবাদে নীতিগত ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেও চলতে পারছে সরকার। নতুন নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলার অভিজ্ঞতাও অর্জন করছে। তাতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিচক্ষণতা আর সাহসও তৈরি হচ্ছে। অর্থনীতিতে যদি কোনো সংকট থেকে থাকে, সরকার তা মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস।

দীর্ঘদিন প্রায় সারা বিশ্বের সঙ্গে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের থাকতে হয়েছে এবং সরকারকেও সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। 

বাংলাদেশ ছোট দেশ, কিন্তু জনসংখ্যা বিপুল। এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনার মতো একটি অতিসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখা যে কত কঠিন, যারা এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন, তারাই কেবল জানেন। তখনও অনেকে বলেছিলেন, সরকার পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে না এবং এখানে লাখ লাখ লোক মারা যাবে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানান সমস্যা আছে সন্দেহ নেই। এজন্য এ সরকারই দায়ী নয়। তবে সাফল্য ওখানে যে, একটা সমস্যাগ্রস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব কাজে লাগিয়ে সরকার করোনা মোকাবেলা করেছে। সংক্রমণকে সীমা ছাড়িয়ে যেতে দেওয়া হয়নি।

করোনার টিকা প্রদানে সরকারের সাফল্যও স্বীকার করতে হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সময়োচিত উদ্যোগের প্রশংসা কে না করবে। অথচ সরকারবিরোধী মহল থেকে এ নিয়েও বিতর্ক তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটা কল্কে পাবে না। কারণ করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। কয়েক দফা করোনা পরিস্থিতি চলাকালে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও লকডাউনে যেতে হয়েছে এবং তাতে বিশেষত দিন এনে দিন খাওয়া জনসাধারণকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সরকার তাদের জন্য যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছে তখন। বিশেষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি নিতে হয়েছে এবং বিরাট জনগোষ্ঠীকে নগদ সহায়তাও জোগাতে হয়েছে। করোনার থাবা থেকে মানুষকে রক্ষায় বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করতে গিয়েও অনেক ব্যয় করতে হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ থেকেও ব্যয় করে টিকা আমদানির দ্রুত ব্যবস্থা করতে হয়।

সেটা ছিল জরুরি পরিস্থিতি এবং সময়মতো টিকা পাওয়া কঠিন ছিল। অথচ এ উদ্যোগ নিয়েও বিতর্ক তোলার চেষ্টা অনেকে করে থাকেন। করোনা পরিস্থিতি চলাকালে সরকারকে কি অর্থনীতিকেও স্বাভাবিক ধারার রাখতে হয়নি? শিল্প ও কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা তখন কঠিন ছিল। বহু লোক একসঙ্গে কাজ করতে হয় যেখানে, যেমন গার্মেন্টস খাত, তা স্বাভাবিক রাখা ছিল খুবই কঠিন। যেসব দেশে আমরা পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করি, সেসব দেশেও করোনা হানা দেওয়ায় রপ্তানি কমে গিয়ে নিজ অর্থনীতিতে সংকট তীব্র হয়ে ওঠে কিনা, সেই প্রশ্ন কিন্তু ছিল। আমাদের উদ্যোক্তারা সরকারের নীতিগত সহায়তা নিয়ে সাফল্যের সঙ্গেই সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। করোনায় অনেক খাতে সংকট তীব্র হলেও মূল খাত গার্মেন্টসে সংকট দেখা দেয়নি। এরই মধ্যে এ খাতে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়; আমরা রপ্তানিকারক হিসেবে ভিয়েতনামকেও ছাড়িয়ে গেছি।

শ্রীলঙ্কায় যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার বড় কারণ কিন্তু করোনাকালে সেখানে পর্যটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। কিন্তু আমরা পর্যটননির্ভর নই। 

আরেকটি কারণ, কৃষিতে তারা আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ পরিহার করায় উৎপাদনে ধস নেমেছিল। 

মানুষের আয় কমে যায় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয় শ্রীলঙ্কায়। খাদ্যশস্য আমদানি করে ঘাটতি পূরণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। করোনায় পর বিশ্বে খাদ্য সংকটও দেখা দেয় এবং একই সঙ্গে জ্বালানির দাম অনেক বেড়ে যায়। রিজার্ভ থেকে সে পরিমাণ আমদানিও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এটা ঘিরেই সংকট তীব্র হয়ে ওঠে এবং এক সময়কার জনপ্রিয় শ্রীলঙ্কান সরকার হয়ে পড়ে অজনপ্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে কি তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে? আগেই বলেছি, বাংলাদেশ পর্যটননির্ভর নয়। আমরা বরং কৃষিনির্ভর এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প পরিমাণ জমিতেও বিপুল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারছি। চালসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এ অর্জনে বর্তমান সরকারের ভ‚মিকাই সবচেয়ে বেশি। আমাদের আমন ফলন ভালো হয়েছে এবং সামনে বোরো মৌসুমকেও সফল করে তুলতে সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ রয়েছে। খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি অবশ্য একটি বড় সমস্যা, যেহেতু দেশে দরিদ্র এখনো কম নয়। করোনাকালে অনেকে আবার নতুনভাবে দরিদ্র হয়ে পড়ে। বেকারত্বও বেড়েছে। কিন্তু এটা কি সারাবিশ্বেই নতুনভাবে সৃষ্টি হওয়া সংকট নয়?

করোনাকাল শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তারও প্রভাব এসে পড়েছে আমাদের অর্থনীতিতে। গোটা ওই অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ায় খাদ্যশস্যের পাশাপাশি জ্বালানির সরবরাহ ও দাম বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। আমরা তো জ্বালানিতে প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। করোনার পর মূলত জ্বালানি ঘিরেই সংকট দেখা দিয়েছে, যা বিদ্যুৎ খাতেও ছড়িয়েছে। জ্বালানি আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে এবং এর দাম বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। এতটা বাড়ানো উচিত ছিল কিনা, সে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে কমে এলে দেশেও কমানো হবে, এটা সরকার বলে রেখেছে। তখন মূল্যস্ফীতি কমে এলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে নিশ্চয়ই।


অন্যান্য দেশের মতো আমাদের রিজার্ভেও কিছুটা টান পড়েছে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় এবং প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ কমে আসায়। সময়ে সময়ে উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য নেওয়া বিদেশি ধারদেনা পরিশোধের কারণেও রিজার্ভে টান পড়ে। তবে ৫-৬ মাসের আমদানি বিল পরিশোধের মতো রিজার্ভ এখনো রয়েছে এবং সরকার এটা রক্ষা করে চলেছে। অহেতুক আমদানিতে যাতে ডলার ব্যয় না হয়, সেজন্য সতর্কতাও জারি আছে। রিজার্ভ নিয়ে যাতে বেশি সংকটে পড়তে না হয়, সেজন্য আইএমএফের কাছ থেকে ঋণও নেওয়া হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতির সূচকগুলো স্বাভাবিক না থাকলে আইএমএফের মতো সংস্থা কি ৪৫০ কোটি ডলার ঋণদানে আগ্রহী হতো?

তারা জানেন, বাংলাদেশ কখনো ঋণখেলাপি হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। তবে কিছু সমস্যা রয়েছে ব্যাংক খাতে এবং এটাও বলতে হবে, পুরো ব্যাংক খাতে নয়। সম্ভবত নজরদারির অভাবেই কিছু ব্যাংক থেকে প্রশ্নবিদ্ধভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে গেছে এবং কিছুসংখ্যক দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ী এতে জড়িত। ব্যাংক কর্মকর্তা, আমলা ও রাজনীতিকদের একাংশের সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ কিন্তু রয়েছে এবং এর সময় ফুরিয়ে যায়নি।

এসব ঘটনা ঘিরে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বৈকি। অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে। এখন প্রধানমন্ত্রীকেই কঠোর হয়ে এক্ষেত্রে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর অফিসিয়াল চ্যানেলে যাতে প্রবাসীরা বেশি করে অর্থ পাঠান, হুন্ডির পরিবর্তে, সে ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত। এটা করা গেলেই রিজার্ভ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা থাকবে না। শ্রীলঙ্কা হওয়ার অপপ্রচার যারা চালাচ্ছে, আমাদের প্রবাসীরাই তার জবাব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রপ্তানিকারক আর কৃষকরা তো রয়েছেনই।   

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image