সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার
রাতে বিদ্যুৎ নেই, লোডশেডিং চলছে। এসময় জরুরি প্রয়োজনে এক প্রতিবেশি হয়তো এসে কলিং বেল না বাজাতে পেরে জোরে কড়া নাড়ছেন। অন্যদিকে পেছনের জানালা দিয়ে বিড়াল ঢুকে টিনের কৌটো ফেলে দিয়ে বিকট আওয়াজ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। এতে ভয় পেয়ে ওই বাড়ির কিশোরবয়সী বাসিন্দা কেউ একজন ফেসবুক স্ট্যাটাস ও চ্যাটে লিখলেন, 'আমাদের বাসায় ডাকাত এসেছে।' সেই স্ট্যাটাস দেখলেন পাশের বাড়ির কেউ। তিনিও লিখলেন, 'আমাদের এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে।' এরপর সেই দুজনের উদ্বিগ্ন আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো স্ট্যাটাসটি। রটে গেল গণডাকাতির খবর। আলো ফিরতেই পুলিশ এসে দেখতে পেলো, কোথাও কোনো ডাকাতির চিহ্ন নেই। কিন্তু ততোক্ষণে এলাকাবাসী বেরিয়ে এসেছেন লাঠিসোঁটা নিয়ে, কারণ ডাকাতদের প্রতিহত করতে হবে! চারিদিকে এ নিয়ে হইচই কাণ্ড।
আলোচনার প্রয়োজনে উল্লেখ করা এই ঘটনাটি কাল্পনিক। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভর করে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কেস স্টাডি ঘাটাঘাটি করলে প্রায় কাছাকাছি অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। অনেকে না বুঝেই এমন ঘটনা ঘটান, আবার কখনো কখনো তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেও ঘটানো হয়। সহজ ভাষায় বিষয়টিকে সবাই 'গুজব' নামেই চেনেন।
বহুকাল ধরে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, 'কান নিয়েছে চিলে'। এ নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের একটি কবিতা ছিল সবার ছোটবেলার পাঠ্যবিষয়, যার একটি পঙক্তি এমন— 'কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে। কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতারবিলে।' কান যথাস্থানে আছে কিনা, সেটি কানে হাত দিয়ে না দেখেই বরং আমরা অন্যের কথায় প্রভাবিত হই। খুব দ্রুত সেই প্রভাব একজন থেকে অন্য অনেকজনের মাঝে বিস্তার লাভ করে। আর যেকোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সংকটের সময় সত্যের চেয়ে মিথ্যা অনেক কথা বেশি ছড়াতে দেখা যায়, যা ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আকার ধারণ করছে। সুস্পষ্টভাবে এর কিছু ধরনও রয়েছে— যেমন গল্পের ছলে মিথ্যা, সৎ বা অসৎ উদ্দেশে কাল্পনিক তথ্য, ভুল তথ্য, অপতথ্য, অর্ধসত্য, গুজব, মিথ্য সংবাদ বা ফেক নিউজ এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডা ইত্যাদি। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়শই মিথ্যা বা বানোয়াট বিষয়গুলো উপস্থাপনের ঢঙ এমন হয় যে, সেটি অবিশ্বাস করারও উপায় থাকে না! অন্যদিকে অনেকসময় উস্কানিমূলক, এডিটেড বা ডিপফেক ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে অস্থিরতা, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
ছাপার অক্ষরে ছাপা হওয়া যেকোনো কিছুকে যেমন সত্য বা গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেওয়ার একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চর্চা সবার মাঝে আছে, তেমনি আগের প্রজন্মের মানুষেরা ডিজিটাল মিডিয়ার স্ক্রিনে দেখা অক্ষরগুলোকেও সেভাবে বিশ্বাস করেন। তারা স্মার্টফোনের পর্দায় যা কিছু দেখছেন— কোনো অথেন্টিক প্ল্যাটফর্ম থেকে সেটি দেওয়া হলো কি না, কিংবা ইউটিউবে একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর যে কথাগুলো বলছেন তার সাপেক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে কিনা, সেটি যাচাই না করেই তা সত্য হিসেবে ধরে নেন। আর এভাবেই জালের মতো করে বিস্তার লাভ করে ভুল তথ্য, অপতথ্য বা অপসংবাদ। সবক্ষেত্রে যে তা মোটাদাগে দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর, তা নয়; তবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে অনেকসময়ই তা মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। যেমন করোনার সময় দুটো জিনিস সোশ্যাল মিডিয়া ছড়িয়েছিল: ১. রসুন খেলে করোনা ঠেকানো যাবে। ২. থানকুনি পাতা খেলে করোনা সেরে যাবে। সেসময় থানকুনি পাতা সংগ্রহের হিরিক পড়ে গিয়েছিল। আবার অতিসতর্কতার কারণে কেউ কেউ প্রচুর রসুন সাবার করে প্রায় মরতে বসেছিলেন! আবার ধর্মীয় অনুভূতিকে ভিত্তি করে কিছু প্রচারণা বেশ আগে থেকে ছড়াতে দেখা গেছে, যেমন এই দোয়াটি ১০ জনকে ফরোয়ার্ড করলে আজ রাতের মধ্যেই একটি সুসংবাদ পাবেন। সঙ্গে রইলো কোনো একটি লিংক। দোয়া ফরোয়ার্ড করায় ক্ষতি নেই, কিন্তু স্প্যাম বা ফিশিং সাইটের লিংকে ক্লিক করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের সুরক্ষা।
কথা হলো, গুজব বা ভুল তথ্য ঠেকাতে কিংবা যাচাই করতে করণীয় কী। ভুল তথ্য থেকে পরিত্রাণ পেতে গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা এখন জোর দিচ্ছেন 'ফ্যাক্ট চেকিং' বা বিষয়ের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাইকরণের ওপর। ফ্যাক্ট চেকিং করার উপায় নিয়ে অনলাইনে অসংখ্য লেখা, টিউটোরিয়াল ও ম্যানুয়াল আছে। রয়েছে আলাদা কোর্সও। অনেক বড় পরিসরে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারও দরকার হয়; তবে সবার পক্ষে তো তা করা সম্ভব নয়। কোনোকিছু ছাড়াই ফ্যাক্ট চেক করার সহজ ধাপ হলো, প্রশ্ন করতে হবে। যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে। অর্থাৎ, সোশ্যাল মিডিয়ায় কারোর শেয়ার করা কোনো একটি পোস্ট দেখামাত্রই যে তা বিশ্বাস করা উচিত হবে, তা নয়। বিষয়টির গভীরতা বা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, এটি আদৌ যৌক্তিক কিনা।
অনেকসময় অসত্য তথ্যের সাথে পুরনো ঘটনার ছবি জুড়ে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে গুগল ইমেজে গিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ছবির মূল উৎস খুঁজে বের করা যায়। হয়তো পৃথিবীর অন্যকোথাও একটি সংঘর্ষে অনেক মানুষ মারা গেছেন, সেই ছবি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ঘটনা বলে চালানো হলো। রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে সেটা সহজে নিশ্চিত হওয়া যায়। আবার কোনো ছবির স্থান-কাল বুঝতে ছবিতে থাকা কিছু নিদর্শন যেমন সাইনবোর্ডের ভাষা, রাস্তার ধরন, যানবাহনের নাম্বারপ্লেট, স্থাপনার রঙ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেও বিষয়টি অনেকখানি বোঝা যায়। এএফপি'র তৈরি ইনভিড বা উইভেরিফাই এক্সটেনশন ব্যবহার করার মাধ্যমেও এই কাজ করা যায়। আবার ধরুন কোনো পত্রিকার নাম করে বলা হলো, আগামীকাল থেকে দেশের ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে। নিচে সূত্র হিসেবে একটি পত্রিকার নাম। আপনি তো খুব সহজেই ওই পত্রিকার ওয়েবপোর্টাল ব্রাউজ করে নিশ্চিত হতে পারবেন, সত্যিই এমন কোনো সংবাদ প্রচার হয়েছে কিনা; নাকি এটি স্রেফ গুজব। কোনো ব্যক্তির নামে কোনো উদ্ধৃতি বা মন্তব্য ছড়ানো হলে সেটিও একই প্রক্রিয়ায় যাচাই করা সম্ভব। ইন্টারনেটে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম আছে, সেসব বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের মাথা খাটিয়েও সঠিক পর্যালোচনা করা যায়। পরিচিত কারোর অ্যাকাউন্ট থেকে যদি কোনো তথ্য ছড়াতে দেখেন, সেটি নিশ্চিত হতে সরাসরি যোগাযোগ করে কথা বলাও একটা ভালো উপায়।
কোনো বিষয়ের সত্যতা যাচাইয়ের অনেকধরনের টুলস অ্যান্ড টেকনিক তো রয়েছে, তবে সেসব নিয়ে লিখতে গেলে এই লেখা আপাতত শেষ করা সম্ভব হবে না। উপসংহার হিসেবে এটুকু বলা যায়, যেকোনো ভুল তথ্য প্রচার ঠেকাতে আপনার নিজের অনুসন্ধানী চোখ ও স্মার্টনেস যথেষ্ট। আপনি যদি নতুন প্রজন্মের হয়ে থাকেন, তবে এই স্মার্টনেস আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত। ফেসবুক-সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কখন কী লিখছেন, কী শেয়ার করছেন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কাউকে কোনো ভুল তথ্য ছড়াতে দেখলে তাকেও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারেন। বাস্তবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই অভ্যাস চর্চা করুন। ফ্যাক্ট-চেকিং এখন ভীষণ জরুরি!
ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ
আপনার মতামত লিখুন: