নিউজ ডেস্ক: ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন এখন কেবলই ধ্বংসস্তূপ। ওই ভবনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচিহ্নগুলো ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত আগুনের ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর থেকে। আশপাশের তিনটি ভবন আর সান্তুর রেস্টুরেন্ট নামে একটি রেস্টুরেন্টও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। এদিন সকালে জাদুঘরের আশপাশের ভবন থেকে চারটি দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
জাদুঘরের গেটসংলগ্ন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি উধাও। লেকসংলগ্ন বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি, যেখানে জাতীয় শোক দিবসসহ বিভিন্ন উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো সেটাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ বিদেশ থেকে আসা রাষ্ট্রীয় অতিথিরাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন। এখন প্রতিকৃতি নেই, কোনোরকমে বেদিটি টিকে আছে। ৩২ নম্বর সড়কের বিভিন্ন স্থানসহ রাসেল স্কয়ার সড়কের সামনে দুপুর পর্যন্ত আগুন জ্বলতে দেখা যায়। সেখানে তখনও পুড়ছিল বিভিন্ন ধরনের বইপত্র।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের মূল গেট পার হলেই দেখা যায় নিচতলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত পুরোটাই এখন ধ্বংসস্তূপ। নিচতলার অভ্যর্থনা ও অফিসকক্ষ থেকে যার শুরু। ভেতরে প্রবেশ করতেই আগুনের ধোঁয়া ও পোড়া গন্ধ। সিঁড়িতে যেখানে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ পড়ে ছিল, সেখানেও ভাঙচুর আর পুড়িয়ে দেওয়ার চিহ্ন।
সিঁড়ির নিচ থেকে শুরু করে দোতলার বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষের দরজা এবং অন্যান্য দরজা ও দেয়ালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাচ দিয়ে ঘেরা গুলির চিহ্নগুলো পর্যন্ত উপড়ে ফেলা হয়েছে। ভেঙে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সব কক্ষের দরজা, জানালা, আসবাব ও ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন। সর্বত্র ছিল আগুনের ক্ষত। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষের খাটসহ তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যবহৃত খাট, চেয়ার-টেবিলগুলোও লুট হয়ে গেছে। বিভিন্ন কক্ষ আর ভবনের দেয়ালে দেয়ালে টানানো ১৫ আগস্ট নিহতদের ছবিসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক দুর্লভ ছবি, মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির ওপর রচিত বই আর তথ্যচিত্রের কোনোটারই দেখা মেলেনি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাপড়-চোপড় আর জুতা-স্যান্ডেল।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গত সোমবার বিকেল ৪টা থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া শুরু হয়। সে সময় স্মৃতি জাদুঘরের পাশের আরও তিনটি বাড়ি এবং সান্তুর রেস্টুরেন্টেও আগুন দেওয়া হয়। এর চারটি বাড়িই বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগের কাজে ব্যবহার হয়ে আসছিল। একটি বাড়ি অবশ্য নির্মাণাধীন। এসব বাড়ি ঘুরেও ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্ন দেখা গেল। এখানে সেখানে পড়েছিল ট্রাস্টের বিভিন্ন কাগজ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তিনটি গাড়িও।
মধ্য দুপুর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও সংলগ্ন এলাকায় উৎসুক মানুষের ভিড় দেখা গেছে। শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু এই ভবনসহ আশপাশ ঘুরে ঘুরে দেখেন।
এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, এই ভবনকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিও জড়িত। আমরা এটিকে রক্ষা করতে এসেছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িতেই সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৪ সালে ভবনটিকে একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর করেন তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
চার মৃতদেহ: বঙ্গবন্ধু ভবনের পাশের দুটি ভবন থেকে পুড়ে যাওয়া চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর মধ্যে স্থানীয়রা সকাল পৌনে ৮টায় একটি ভবনের পুড়ে যাওয়া স্থাপনা থেকে তিনটি এবং আগুন নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বেলা সোয়া ১টায় সান্তুর রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকে আরেকটি মরদেহ উদ্ধার করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি।
দুপুরের দিকে ধানমন্ডির বাসিন্দা সাথী খাতুনকে দেখা যায় পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া একজনের মরদেহ ধরে বিলাপ করছেন। তাঁর দাবি, তাঁর ছেলে ইউসুফের (১৭) মরদেহ এটি। সে স্থানীয় একটি স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ধানমন্ডির বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, মা দেশ স্বাধীন করতে যাচ্ছি।
ইউসুফের পাশে থাকা আরেকটি ১২-১৩ বছরের এক শিশুর মরদেহের কোনো দাবিদার দেখা যায়নি। আগেই অন্য দু’জনের মরদেহ তাদের স্বজন নিয়ে যান বলে দাবি করেন প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন।
ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ
আপনার মতামত লিখুন: