রূপম ভট্টাচার্য্য, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : ‘ছেলেরে নিয়ে আমি কত কষ্ট করছি। আমার আব্বু অনার্স পাস করবে, ভালো চাকরি করবে। আমি দায়িত্ব বুঝাই দিমু। সে তো আমার হাতেই দায়িত্ব দিয়া গেল। ও শান্ত মনি, তুমি যে দায়িত্ব নিলা না। আমার তো অনেক আশা ছিল। আমাকে সেরা মা করবে। আমারে যে এভাবে সেরা মা করে দিয়া যাইবে আমিতো বুঝি নাই।’
বিলাপ করতে করতে এসব বলছিলেন চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে নিহত ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা কহিনূর আক্তার। দশ মাস গর্ভে ধরে যাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন, যাকে নিয়ে বুনেছেন হাজার স্বপ্ন-সেই কলিজার টুকরা ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তিনি।
‘মোবাইলে অ্যালার্ম বাজলে আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়, আমার মানিকের তো ঘুম ভাঙে না। আমার বুকটা এমন খালি করলো কে? কে আমার বাবার বুকে গুলি করলো? আমার কলিজাটা শুকাইয়া গেছে। আমি শ্বাস নিয়া তো কুলাইতে পারি না। আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। ওই শান্তই আমার স্বপ্ন, ওই শান্তই আমার সবকিছু। ঘরে আসলেই আম্মু কইয়া ডাক দিতো। কতদিন ধইরা আমার শান্ত আমারে আম্মু কইয়া ডাক দেয় না।’- বলতে বলতে মুর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি।
ফয়সাল আহমেদ নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। সে বন্দর থানার ফ্রিপোর্ট এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারসহ থাকতো। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামে। তিনি একই গ্রামের জাকির হোসেনের ছেলে।
গত ১৬ জুলাই বিকেলে নগরের মুরাদপুর-ষোলশহর এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় অনেকের হাতেই ছিল দেশীয় অস্ত্র ও গুলি। সংঘর্ষে পুরো এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সেদিন নিহত হন তিনজন। যাদের মধ্যে ছিলেন ফয়সাল আহমেদ শান্তও।
গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফয়সালের পরিবারের সাথে সাক্ষাত করতে যান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। যাদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের দুই সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ এবং খান তালাত মাহমুদ রাফিও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্রিপোর্ট মোড় হয়ে এম এ আজিজ সড়ক লাগোয়া ঝনক প্লাজা মার্কেটের পাশের একটি সরু কলোনির ভাড়া বাসায় থাকে তাঁর পারিবার। ঘরের উপরে টিনশেড এবং চারদিকে দেওয়াল ঘেরা। দুই রুমের ওই বাসায় আছেন ফয়সাল আহমেদের মা কহিনূর আক্তার, ছোট বোন বৃষ্টি এবং তার নানি। ফয়সালের বাবা গ্রামের বাড়িতে ফার্নিচারের ব্যবসা করেন।
ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল, কহিনূর বেগমের মুখে আওয়াজ নেই, বিমর্ষ। দুই চোখ স্যাঁতসেঁতে অশ্রুজলে। পাশেই বসা ছিল ছোট বোন বৃষ্টি। রাসেল-রাফিকে দেখতেই যেন তাঁর মনে পড়ে গেল নাড়িছেঁড়া ধন ফয়সালের কথা। হঠাৎ ছলছল করে উঠলো দু-চোখ।
গগনবিদারী আহাজারিতে করে তিনি বলেন, ‘আমার মানিকেরে কে গুলি করলো? ওরে (ঘাতক) একটু আমার কাছে নিয়া আসো, আমি শুধু জিজ্ঞেস করবো তোমার বুকটা একটু কাঁপলো না? সবাই বলে ও শান্ত ছেলে। আমার মানিকেরে কেমনে গুলি করলা তুমি? ওরে আমার শান্ত মানিক। আমার শান্ত মানিক রক্তাক্ত হইয়া গেলো।’
রাসেল শান্তনা দিয়ে তাঁকে বলেন, ‘আমার ভাইকে তো আমরা ফিরিয়ে দিতে পারবো না। আমাদেরকে আপনার সন্তান হিসেবে ভাববেন। আপনি আমাদের আম্মু।’
রাসেলের কথা শেষ না হতেই কহিনূর বিলাপ করে বলতে লাগলেন, ‘আমার মানিকের হাত কাইট্টা গেলে কইতো আম্মু রক্ত বের হয়, ও আম্মু ব্যাথা করে। আমার মানিকের কি এখন ব্যাথা করে না? আমার মানিকটায় ঠান্ডা লাগাইতে পারে না। আমার মানিকের কাশি হইয়া যায়। আমার মানিকের কি এখন ঠান্ডা লাগে না? আমার মানিকের কি এখন কাশি হয় না? ও মানিক রাতে ঘুমাও না এখনও? ও মানিক একটু ঘুমাও। আমার মানিক ঘুমাই গেছে।’
এমন আহাজারিতে মুহূর্তেই চোখ টলমল করে উঠলো উপস্থিত সবার। কেউ
কেউ অশ্রুজল সংবরণ করতে পারলেও রাফি সামলাতে পারেননি নিজেকে। তাঁর চোখ দিয়ে গড়গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু, ওদিকে দুহাত দিয়ে বারবার মুছে দিচ্ছিলেন মায়ের চোখও। বললেন, ‘আমি আপনার ছেলে। আপনি আমাকে বাবা বলে ডাকবেন।’
রাসেলও বিচারের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আপনার ছেলেরা কথা দিচ্ছে, যারা আমাদের ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। আমরা তাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাবো।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কহিনুর আক্তারকে সান্তনা দিয়ে বলেন, ‘আপনি একটু ধৈর্য ধরেন। ফয়সালের যারা সহযোদ্ধা তারা এসেছে। আমরা আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই আপনার ছেলের খুনীদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে এবং অবশ্যই তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনা হবে।’
চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হবে। হত্যাকারীদের বিচার অবশ্যই হবে।’
ফয়সাল আহমেদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তাঁর বাবা জাকির হোসেন আগে চট্টগ্রামে জাহাজে চাকরি করলেও করোনাকালে তিনি গ্রামের বাড়ি বাবুগঞ্জে ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেন। আর মা প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা।
জাকির হোসেন গ্রামে ব্যবসা শুরু করলে ফয়সাল, তাঁর অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া বোন বৃষ্টি ও তাঁদের মা চট্টগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেন। ফয়সাল পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে হাত খরচ চালাতো। তাঁর ছোট বেলা থেকে বেড়ে ওঠা বাবুগঞ্জ উপজেলার মহিষাদী গ্রামের নানার বাড়িতে।
গতকাল রাতে ফয়সাল আহমেদের মা কহিনূর আক্তারের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এখনো কোনো আর্থিক সহায়তা পাইনি। সরকারের পতনের আগে শুনেছিলাম সহায়তা দেওয়া হবে। কিন্তু এরপর ছেলের দাফনের জন্য বাড়িতে চলে যাই। বাড়িতে থাকায় পরে কি হয়েছে তা জানি না। এখন এসব নিয়ে কথা বলার অবস্থায় নেই আমরা।’
ফয়সাল আহমেদের বাবা জাকির হোসেনের দাবি, তাঁর ছেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না। সংঘর্ষের দিন বিকেলে টিউশনি করার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল শান্ত। পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর শরীরে তিনটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন তখন জানিয়েছিলেন, ফয়সালকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল। চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: