রূপম ভট্টাচার্য্য, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : দশ একর জায়গা জুড়ে বিশাল অবকাঠামো। রয়েছে সম্প্রচার কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। মানসম্মত অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে দক্ষ জনবল। রয়েছেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী- কলাকুশলীও। সবই আছে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে। নেই শুধু সংবাদসহ মানসম্মত অনুষ্ঠান।
সম্ভাবনাময় এই টিভি কেন্দ্রের দুর্গতির পেছনে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম-দুর্নীতিই মূল কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হওয়া এই কেন্দ্রকে শ্বেতহস্তী বলে অভিহিত করছেন কেউ কেউ। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও তা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। চট্টগ্রামের অনেক শিল্পী ও ব্যান্ড দল জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখছেন। কিন্তু নতুন করে এখান থেকে শিল্পী গড়ে তোলার কোন ভুমিকাই রাখতে পারেনি সিটিভি কর্তৃপক্ষ।১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের যাত্রা। গত ৩০ বছরে চট্টগ্রাম কেন্দ্র লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ শিল্পীদের।
বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানের নাম ‘রান্না কথন’। এর প্রযোজক কন্ট্রোলার বা প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিন। ৫ সেপ্টেম্বর প্রচারিত ২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন একজন উপস্থাপক ও একজন আলোচক। অথচ বিল করা হয়েছে ১২ জনের নামে। এর মধ্যে আটজনই আলোচক। বিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, উপস্থাপিকা ২ হাজার টাকা, আলোচক ৩ হাজার ও অনুষ্ঠান সহকারী দু’জন ৪ হাজার ৩৩২ টাকা সম্মানী পেয়েছেন। একটি রান্নার অনুষ্ঠানে আটজন আলোচক থাকার বিষয়টি অবাস্তব বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সব মিলিয়ে এই অনুষ্ঠানে সর্বমোট ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হলেও বিল করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৫৩২ টাকা।
মহেশখালীর ধলঘাটা দ্বীপ নিয়ে ‘দ্বীপ দর্পণ’ অনুষ্ঠানের প্রচার দেখানো হয়েছে ২ আগস্ট। বাজেট ৯৯ হাজার ৪১০ টাকা। এই অনুষ্ঠানে উপস্থাপক, নেপথ্যে ধারা বর্ণনাকারী ছাড়াও সাক্ষাৎকার প্রদানকারী হিসেবে ১৮ জনের নামে প্রায় ৭০ হাজার টাকা বিল করা হয়েছে। বাজেটে ‘দ্বীপ দর্পণ’ অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ২৫ মিনিট উল্লেখ থাকলেও প্রচারিত অনুষ্ঠানের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৫.১৭ মিনিট। ৫ মিনিটের অনুষ্ঠানে ১৮ জনের সাক্ষাৎকার প্রচারও অবাস্তব বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এভাবেই বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রে শিল্পী সম্মানীর নামে অর্থ লোপাট অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোমানা শারমিনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গত দেড় বছরে অনুষ্ঠানমালার বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় ৬ কোটি টাকা লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিয়মিত অনুষ্ঠান ধারণ ও প্রচার প্রায় বন্ধ থাকলেও ২ কোটি ২০ লাখ টাকা বাজেট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দেড় কোটি টাকা উত্তোলনও করা হয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনুষ্ঠান শাখার বাজেট ছিল ৮ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিএম নুর আনোয়ার হোসেন রঞ্জুর সময় বাজেট বেড়ে হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেট ৫ কোটি টাকা বাড়লেও অনুষ্ঠানের সংখ্যা ও মান ছিল নিম্নমুখী।
অর্থ লুটপাটের জন্য প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানের বাজেট বাড়ানো হয়েছে কয়েক গুণ। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ৩৪৩টি বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মাণে খরচ হয় ৪৭ লাখ ১৩ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে শুধু ১০৬টি বিশেষ অনুষ্ঠান নির্মাণে মোট বাজেট ছিল ৬১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গড়ে প্রতিটি অনুষ্ঠানের বাজেট চার গুণ বেড়েছে।
‘দ্বীপ দর্পণ’ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে অতিথি প্রযোজক সাখাওয়াত হোসেন মিঠু বলেন, ‘অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি কমবেশি হতে পারে। কিন্তু সময় কমলেও কোয়ালিটি নিয়ে আপস করিনি। অনুষ্ঠানে যাদের সাক্ষাৎকার প্রচার হয়েছে, কেবল তাদের নামেই বিল করা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক জিএম আনোয়ার হোসেন রঞ্জু, নিতাই কুমার ভট্টাচার্য মাহফুজা আক্তার, মনোজ সেন গুপ্ত ও জাঁ নেসার ওসমানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। মাহফুজার বিরুদ্ধে ২১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রে বহির্দৃশ্য ধারণের জন্য দুটি ক্যামেরা রয়েছে। রয়েছে প্রয়োজনীয় জনবলও। কিন্তু ওই ক্যামেরাগুলো অকেজো দেখিয়ে বাইরে থেকে বেশি টাকায় ক্যামেরা, ড্রোনসহ নানা উপকরণ ভাড়া নেওয়ার দাবি করা হতো। এই ব্যয়কে শিল্পী সম্মানী হিসেবে দেখানো হতো। এভাবে দু’জনের অনুষ্ঠানে আটজন, চারজনের অনুষ্ঠানে ১৫-২০ জন আলোচক ও সাক্ষাৎ প্রদানকারীর নামে বিল করা হতো। আলোচক ও সাক্ষাৎকার প্রদানকারীরা মূলত সিন্ডিকেটের লোক ছিলেন।
এসব বহিরাগত শিল্পী সম্মানীর চেক নিয়ে টাকা উত্তোলন করে এর বড় অংশ প্রযোজক বা সংশ্লিষ্টদের কাছে ফেরত দিতেন বলে জানা গেছে। এভাবে একেকটি অনুষ্ঠানে প্রয়োজনের তিন-চার গুণ বিল করে টাকা আত্মসাৎ করা হতো।রোমানা শারমিন ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ‘সংকল্প’ শীর্ষক ১৩ পর্বের একটি ধারাবাহিক নাটককের জন্য ৯ লাখ টাকা বাজেট দেখিয়েছেন। ওই নাটক নির্মাণই করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে রোমানা শারমিন কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন ‘চট্টগ্রাম কেন্দ্রে অনুষ্ঠান ধারণের লোকবল ও উপকরণের ঘাটতি আছে। বহির্দৃশ্য ধারণে ক্যামেরা, ড্রোন, লাইট, গাড়িসহ নানা কিছু ভাড়া করতে হয়। কিন্তু বিল করতে হয় শিল্পী সম্মানী হিসেবে।’ প্রডাকশন খরচ কেন শিল্পী সম্মানী হিসেবে বিল করা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই রীতি আগে থেকেই চলে আসছে। তবে প্রডাকশন খরচকে শিল্পী সম্মানী হিসেবে দেখানো উচিত হয়নি। এখানে সংস্কার দরকার। অনুসন্ধানে জানা যায় চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রচারিত ৩১ পর্বের ‘বিজয় গাথা অনুষ্ঠান’ নির্মাণে বাজেট ছিল ১২ লাখ টাকা। অথচ ২০২২ সালে ৩১ পর্বে খরচ হয়েছিল মাত্র ৪ লাখ টাকা।
২০২৩ সালে ‘বদলে গেছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে সরকারের উন্নয়ন প্রচারধর্মী ৯৮ পর্বের অনুষ্ঠানে খরচ দেখানো হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ফুটেজ দিয়ে এসব অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ টাকাই আত্মসাৎ করা হয়েছে। সংবাদ নিয়ে ও অভিযোগের শেষ নেই, কোন ভালো রির্পোটিং হয় না, চট্টগ্রামে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে এসব নিয়ে ও রিপোর্ট হয়নি এই পর্যন্ত, অনুষ্ঠানের সেট নির্মাণ ও নেই নতুনত্ব, এক সেট দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করানো হয় বলে শিল্পীরা অভিযোগ করেন।
বিশেষ গ্রেড়ের তালিকা ভুক্ত শিল্পী বিনাপানি চক্রবর্ত্তী বলেন তিনি টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করেছেন ২০১৯ সালে তাকে এই পর্যন্ত ডাকা হয়নি। অভিযোগের সুরে একজন সুরকার বলেন আমি বিশেষ গ্রেড়ের হয়েও চার মাস ধরে কোন প্রোগ্রাম পায়নি।একাধিক তালিকাভুক্ত শিল্পীর সাথেআলাপকালে জানা গেছে, এই কেন্দ্রেপ্রায় ৬'শ তালিকাভুক্ত শিল্পী থাকলেওপ্রোগ্রাম পান হাতেগোনা কিছু শিল্পী।এখানে কেউ কেউ মাসে একাধিকঅনুষ্ঠান করার সুযোগ পান। বাকিরা ছয়মাস এক বছরেও সুযোগ পান না। তবেযারা অনুষ্ঠান করার সুযোগ পান তাদেরসম্মানির চেক পেতেও কাঠখড় পোহাতেহয়। চেক পেতে পেতে টাকা তোলারসময় চলে যায়। এত জনবল ওআনুষিঙ্গিক সরঞ্জাম থাকা সত্তে¡ও এটিএকটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নির্মিত অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে অভিনেতা জায়েদ খানসহ বিভিন্ন শিল্পীকে আনা হয়।
এক দিনের অনুষ্ঠানে বাজেট দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। এ থেকে অন্তত ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের জনপ্রিয় শিল্পী কল্যাণী ঘোষ বলেন, ‘চট্টগ্রাম টেলিভিশন কেন্দ্রের বর্ষপূর্তিতে ঢাকা থেকে শিল্পী এনে অনুষ্ঠান করা হয়েছে, অথচ চট্টগ্রামের কোনো গুণী শিল্পীকে দাওয়াতই দেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামের শিল্পীদের বঞ্চিত করা হয়েছে।’ অভিযোগ রয়েছে অতিথি প্রযোজক বৈদ্যনাথ অধিকারী, শাখাওয়াত হোসেন মিঠু, রিফাত মোস্তফা টিনা, শওকত ইকবাল, আফরোজা চৌধুরী দিনা, মোস্তাফিজুর রহমান, নিউজে আছেন নাসরিন সুমি এরা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সুপারিশে নিয়োগ প্রাপ্ত, এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় সরকারী অর্থ আতœসাৎ, স্বেচ্ছারিতা, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ সহ অসংখ্য দূর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে এই সব প্রযোজকের বিরুদ্ধে।এদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ড. শিরিন শারমিন এর কন্যারিফাত মোস্তফা টিনা, তার বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ কেলেঙ্কারি অভিযোগ ও রয়েছে।
সদ্য যোগদানকারী জিএম ইমাম হোসেন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বপ্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়া। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে সেটা আমি নিশ্চিত করব।’
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: