
নিউজ ডেস্ক: মুজিব-ইয়াহিয়া' আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গেছে- ঢাকায় এ খবর ছড়িয়ে পড়েছিল ২৫ মার্চের সকালেই। দাবানলের মতো এ খবরও ছড়িয়ে পড়েছিল, যে কোনো সময় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হবে। মানুষজন ভিড় জমিয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। বেশ কয়েকবার বঙ্গবন্ধু ব্যালকনিতে এসে বক্তব্যও দেন তাদের উদ্দেশে। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই থমথমে হয়ে উঠতে থাকে।
তার পর নেমে আসে ভয়ংকর কালরাত। ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে ঘুমাতে যাওয়া মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। মুক্তিকামী জনগণকে স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তানের খুনি সামরিক বাহিনী পরিচালনা করে 'অপারেশন সার্চলাইট'। এটি পরিণত হয় একটি যুদ্ধাপরাধী সামরিক বাহিনীতে; যে বাহিনী সুস্থ ও ঠান্ডা মাথায় পৃথিবীর ভয়ংকর গণহত্যা চালিয়ে সেই কালরাতেই হত্যা করে অর্ধলাখ মানুষকে।
অবশ্য সেই কালরাতে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি বলেই মনে করেন অনেকে। কারণ, ২৫ মার্চ থেকেই নেমে এসেছিল ভয়ংকর বিধিনিষেধ; সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যার তথ্য গোপনের চেষ্টা করেছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ লক্ষ্যে ২৫ মার্চের কালরাতের আগেই বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব বাংলা ত্যাগে বাধ্য করা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই রাতে ঢাকায় লুকিয়ে ছিলেন সাংবাদিক আর্নল্ড জেটলিন, মাইকেল লরেন্ট, সায়মন ড্রিং প্রমুখ। কয়েক দিন পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদন থেকে বিশ্ববাসী এই গণহত্যা সম্পর্কে আংশিক ধারণা পায়। পুরান ঢাকায় ৭০০ মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা ও হলগুলোয় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে- এমন সব অসম্পূর্ণ খবর থেকেই বিশ্ববাসী বুঝতে পারে, স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে গণহত্যার মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী।
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে ২৫ মার্চের এ দিনটি পালন করা হচ্ছে 'গণহত্যা দিবস' হিসেবে। জাতিসংঘ এবং বিশ্বের সব দেশ যাতে এ দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস' হিসেবে পালন করে- এর সপক্ষেও জনমত দিন দিন প্রবল হয়ে উঠছে।
২৫ মার্চের কালরাতে পরিচালিত 'অপারেশন সার্চলাইটের' পরিকল্পনা করা হয়েছিল অবশ্য আরও আগেই- ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চে। 'রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যর্থ হলে সামরিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা' ছিল এ অপারেশনের উদ্দেশ্য।
এর আগের দিন ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোন করে কমান্ড হাউসে ডেকে নেন তার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন।
পরদিন সকালে ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় বসে তারা দু'জন এ পরিকল্পনা রচনা করেন। ঢাকা অঞ্চলে অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব নেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। 'অপারেশন সার্চলাইটের' এ অংশটির পরিকল্পনা রচনা করেন তিনি। খাদিম হুসাইন রাজা দায়িত্ব নেন 'প্রদেশের' অন্যান্য অংশে সামরিক অভিযান পরিচালনার। সে অনুযায়ী এ অংশের পরিকল্পনাও করেন তিনি।
খাদিম হুসাইন রাজার এডিসি ছিলেন বাঙালি। রাজা পরবর্তী সময় তার স্মৃতিচারণমূলক বই 'আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ঔন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১'-এ লিখেছেন যে, ওই দিন সকালে তিনি তার স্ত্রীকে দায়িত্ব দেন, তার বাঙালি এডিসিকে অফিস থেকে অন্য কোথাও ব্যস্ত রাখার। যাতে বিষয়টি সে টের না পায়।
কথা ছিল, আওয়ামী লীগ এদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত করা সংবিধানের খসড়া প্রতিবেদন জমা দেবে। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসসিএমএম পীরজাদার এ জন্য যোগাযোগ করার কথা থাকলেও সারাদিনেও তিনি তা করেননি। সন্ধ্যায় কোনো রকম যোগাযোগ ছাড়াই জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিমানে করে ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান।
এ খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। রাত ৯টায় তিনি ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে তার বাসার সামনে সমবেত নেতাকর্মী, সমর্থক, সাংবাদিক ও জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেন, "আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।"
ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাত ১০টার দিকে গণহত্যার উদ্দেশ্যে বড় কনভয় নিয়ে যুদ্ধ সাজে ঢাকায় নেমে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। দেশের মানুষও সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধে।
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: