সালেক উদ্দিন
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলনে বিজয়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট ২০২৪-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে শপথ নিলেন তিনি।
একটি মানুষ এক জনমে সর্বোচ্চ যতটা সম্মানে ভূষিত হতে পারেন তার সবটাই আন্তর্জাতিক পরিসরে ড. ইউনূস পেয়েছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ভূষিত হয়েছেন আমেরিকার প্রসিডেন্সিয়াল অ্যাওয়ার্ডে, পেয়েছেন মার্কিন কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ড। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানের এই তিনটি পুরস্কারে যারা পুরস্কৃত হন তাদের আর দুনিয়ার কাছে কিছু চাওয়ার থাকে না।
এছাড়াও ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে অজস্র পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে তিনি। তাঁকে সম্মানিত করতে পেরে পৃথিবীর অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানই নিজেদের ধন্য মনে করেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বের জীবিত লিডিং ইন্টালেকচুয়ালের যেকোনও তালিকাতে প্রথম তিন জনের মধ্যে তিনি একজন। অনেকের মতে তার অবস্থান ১ নম্বরে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বব্যাপী সম্মাননার কথা একটি লেখায় লিখে শেষ করা যায় না। অতি সম্প্রতি তিনি ২০২০ সালের জাপান অলিম্পিকের প্রধান অতিথি ও মশালবাহক ছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এ বছরের প্যারিস অলিম্পিকের মূল থিম করা হয়েছে। এটা একটা মানুষের জন্য এবং সেই মানুষটি যেই দেশ বা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই দেশের সেই সমাজের জন্য যে কত বড় গর্বের বিষয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক। বাংলাদেশে যেখানে শক্ত সামর্থ্য জামানত রেখেও ব্যাংকের ঋণ খেলাপির তালিকা কমানো যায় না সেখানে জামানত ছাড়াই ভূমিহীনদের যে ঋণ দেওয়া যায় তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। এই নিঃস্ব ভূমিহীন পিছিয়ে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে যে ব্যাংক ঋণের আওতায় আনা যায় এবং তাদের জীবনের অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি দেওয়া যায়, এই ধারণার প্রবর্তন করেন তিনি।
ড. ইউনূস ভূমিহীনদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের ধারণা লালন করেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এই ঋণ প্রকল্প চালু করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে রূপ লাভ করে।
আমি মহাভাগ্যবানদের একজন যে সেই সময় থেকে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের প্রথম ৪ বছর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমরা যারা খুব কাছে ছিলাম তারা দেখেছি তার সৃষ্টিশীলতা, মনোবল এবং মানুষের কল্যাণের জন্য ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে যাওয়ার ক্ষমতা, সফলতা বের করে আনার ক্ষমতা, সমাজ পরিবর্তনের দক্ষতা।
তখনই আমরা স্বপ্ন দেখতাম গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্রের এই সম্ভাবনাময় দেশটি যদি কোনোদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে পড়তো তবে সারা পৃথিবীর অনুকরণীয় নতুন একটি দেশ হতো বাংলাদেশ।
ওয়ান ইলেভেনের পটপরিবর্তনের পর তিনি যখন নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তখন আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবের খুব কাছাকাছি বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির, সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গিয়েছিল। এবার সময় এসেছে তার পরিপূর্ণতা লাভ করার।
ড. ইউনূসের শুধু ক্ষুদ্র ঋণ তত্ত্বই নয়, তার সামাজিক ব্যবসা এবং থ্রি জিরো তত্ত্ব গ্লোবাল কমিউনিটি গ্রহণ করেছে।
বিশ্ববরেণ্য এই চিন্তাবিদ, সমাজসেবক, অর্থনীতিবিদ রাজনীতির দাবার চালে নিজ জন্মস্থান বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। পৃথিবীর কাছে হেয় করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ১৬৮টি বা তারও বেশি দুর্নীতির মামলার বোঝা শেখ হাসিনা সরকার চাপিয়ে দিয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাথার ওপর।
প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। স্বৈরাচারের যেমন একদিন পতন হয়, তেমনি যোগ্য মানুষটি তার যোগ্য স্থানে একদিন অধিষ্ঠিত হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তাই তো গণ-আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে অধিষ্ঠিত হলেন।
এই মহান ব্যক্তির মেধা মনন ও উদ্যোগে সমাজের একটি নিগৃহীত গোষ্ঠী যেমন আলোর দিশা পেয়েছে, তেমনি অপরাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট এই দেশ একটি নতুন বাংলাদেশে পরিণত হবে, এটাই দেশবাসীর তথা বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা। তিনি পরীক্ষিত একটি সূর্য। আমরা নিশ্চিত এই সূর্যের সামনে যদি ঘন মেঘ অন্তরা হয়ে না দাঁড়ায় তবে তাঁর আলোকে আলোকিত হবে নতুন বাংলাদেশ। যা বড় বেশি প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচন সম্পাদন করাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শেষ কর্ম- সেটা প্রত্যাশা হতে পারে বর্তমান কালচারের রাজনৈতিক দলসমূহের। তবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নয়।
মানুষের ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করলেই এ দেশের দীর্ঘদিনের একনায়কতন্ত্র, দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে তা নয়। দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তন আনতে হলে স্বৈরতন্ত্রের নাড়িনক্ষত্র উৎপাটন করে নতুন সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে হবে। তৈরি করতে হবে একটি মজবুত প্ল্যাটফর্ম, যা অতি অল্প সময় বেঁধে দিয়ে সম্ভব নয়। এর জন্য তাঁকে যুক্তিসঙ্গত সময় দিতে হবে।
এটা সত্য যে নতুন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করা পৃথিবীতে যে কজন গুণীজনের পক্ষে সম্ভব তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি পারেন অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে। তিনি ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা ইত্যাদির মতো এমন একটি ফর্মুলা আমাদের উপহার দিতে পারেন, যা ব্যবহার করে স্থায়ী গণতন্ত্রের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। যা পৃথিবীজুড়ে মানুষের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকতে পারে।
এ দেশের মানুষ আর বর্তমান ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য দ্রুত নির্বাচন চায় না। বরং তারা চায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটি রাজনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে যান, যার সুবাদে দীর্ঘদিনের লালনকৃত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, অর্থপাচারের রাজনীতি ইত্যাদি আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। প্রকৃত গণতন্ত্রের রাজনীতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। সৎ, সাহসী, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান অদম্য মনোবলের রাজনীতিক সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের গণমানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ
আপনার মতামত লিখুন: