মোহাম্মদ ইউনুছ অভি, টেকনাফ প্রতিনিধি : কক্সবাজার টেকনাফ -মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যে নাফ নদী এখন মাদক আর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের রুট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আট বছরের ব্যবধানে চিত্র পাল্টে গেছে । ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সময় মিয়ানমার সরকারের চিঠিতে বন্ধ হয়ে যায় বৈধ বাণিজ্যিক সব কার্যক্রম। বাংলাদেশের ৫৪ কিলোমিটারের নাফ নদী মিয়ানমারে সংঘাতের নীরব সাক্ষী। অথচ এ নদীর ঢেউয়ের তালে ঘুরতো এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা। এখন সেখানে কেবল নিরবতা।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে থাকা এ নদী ছিল জেলেদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন। অন্তত ১০ হাজার জেলে এখন পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।ইয়াবা পাচার বন্ধের অজুহাতে প্রায় আট বছর ধরে নাফ নদীতে জাল ফেলা নিষিদ্ধ থাকায় দুর্দিন চলছে জেলে পরিবারে।
২২ সালের ৯ জুলাই দেশের খামারিদের কথা চিন্তা করে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপে মিয়ানমার থেকে গবাদি পশু আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। মিয়ানমার থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীরা মাংসের দামও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছেন।
কক্সবাজার টেকনাফ পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে যে গরু আসে, সেগুলো প্রথমে রাখা হয় শাহপরীর দ্বীপ করিডোরে। এরপর বিজিবির তদারকিতে টেকনাফ গবাদিপশু শুল্ক করিডোরের মাধ্যমে ভ্যাট প্রদান করা হয়। পরে সেখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী গরু পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
শুল্ক বিভাগ জানায়, চোরাই পথে গবাদি পশু আসা রোধে ২০০৩ সালে ২৫ মে শাহপরীর দ্বীপ করিডোর চালু করে সরকার। করিডোর প্রতিষ্ঠার পর গবাদি পশু আমদানি থেকে সরকার প্রায় ১৮ বছরে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আয় করে।
এই করিডোর ধরে পশু আনার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ থাকলেও, গত দুই বছর ধরে মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং আমদানির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট শত শত দিনমজুর পরিবারের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
মোহাম্মদ কাশেমের পশুবাহী ট্রলার খালাসের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গত ৩ বছর ধরে মিয়ানমার থেকে গবাদি পশু আসা বন্ধ। এতে আমাদের সংসারেও দুর্দিন চলছে। এত দিন ধরে করিডোরে কাজ করে দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করতাম। সেগুলো নিয়ে ভালো মতো সংসার চলতো। আর এখন খুবই খারাপ অবস্থা। মিয়ানমার থেকে আসা পশুবাহী ট্রলার খালাসের সঙ্গে চার ধরনের প্রায় আড়াইশ' দিন মজুর কাজ করে থাকে। আজ তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েেছে।’ফলে এ সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
জেলেদের মধ্যে একজন কবির হোসেন। জীবন, যৌবনের উত্তাল সময় কেটেছে নদীর ঢেউয়ে। মাছ ধরে ৫ জনের সংসার চালিয়েছেন গত ৪০ বছর। এখন নদী পাড়ে বসে স্মৃতি রোমান্থন করে কাটছে তার সময়। পাশেই জেলেপাড়া। তার মতো সচ্ছল অনেকেরই এখন দিন কাটছে অস্বচ্ছলতায়। লাখ লাখ টাকার নৌকা আর জাল নষ্ট হয়েছে পানিতে ডুবে। জানান, বাপ দাদার হাত ধরে জেলে পেশায় এসেছেন, অন্য কওন উপায় না থাকায় কখনো কখনো প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরেন। কিন্তু তাতে সংসার চালানো দায়।
আরেক জেলে কবির আহমদ বলেন, 'আমাদের পুঁজিটাই ছিল নদী থেকে মাছ মেরে অন্নের সংস্থান করা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বিয়ে সবকিছুতে এ নদীর উপর ভরসা আমাদের। এখন পেট চালানোই দায়, মাছও মারতে পারি না।'
জেলেরা বলছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এমনিতেই নাফ নদীতে নানা সময়ই মাছ ধরার ওপর বিজিবির বিধিনিষেধ থাকে। এর মধ্যে আবার ইয়াবা পাচারের অজুহাতে সেখানে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। অথচ দেশে ইয়াবা আসা বন্ধ হচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞার প্রায় আট বছর পরও নদীতে জাল ফেলার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় দুঃখ-কষ্টে দিন কাটছে।তারা এ পেশা (মাছ শিকার) ছাড়তে পারবেন না। প্রয়োজনে এর জন্য তারা বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেবেন। নাফ নদীতে মাছ ধরার অনুমতি পেতে এরই মধ্যে ইউএনও বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন।
উপার্জনের তাগিদে ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছেন অনেকে। কেউ সিএনজি বা টমটম চালিয়ে, কেউ দিন মজুর বা শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন। অভাব-অনটনের সংসারে , আয় বাড়াতে বাধ্য হয়ে মাটি কাটাসহ নানা কাজ করছেন এখানকার গৃহবধুরাও।
জেলেদের দাবি, গত ৮ বছর মাদকের চোরাচালান না কমে উল্টো বেড়েছে। জনমানব না থাকার সুযোগে নদীর কয়েকটি দ্বীপ চলে গেছে রোহিঙ্গা ডাকাত দলের নিয়ন্ত্রনে। এখন তোতার দ্বীপ, লাল দ্বীপ, জালিয়ার দ্বীপসহ কয়েকটি দ্বীপে অবস্থান করছে ডাকাত দল। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে অপহরণ,খুন সবই করছে তারা। অথচ মাছ ধরতে না পেরে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে তাদের।স্থানীয়রা বলেন, 'মাছ ধরা নিষিদ্ধের পর বেড়েছে আর্থিক অনটন। বাচ্চাদের লেখাপড়াও করাতে পারছি না। নাফ নদীতে মাছ ধরার অনুমতি দিতে সরকারের কাছে আবেদন জানাই।'
কক্সবাজার জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান জীবিকা মাছ শিকার আর মিয়ানমার থেকে গরু মহিষ আমাদানিতে শ্রমিক ছিল দুই শতাধিক। ইয়াবা কারবারিদের দোহাই দিয়ে গরিব জেলেরা না খেয়ে মারা যাবে, তাদের জীবিকা বন্ধ করে দেবে, এটা মেনে নেয়া সম্ভব না। আমরা জানি উখিয়া টেকনাফের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি নিজেই এ করিডোর বন্ধ রেখেছিল।তার স্বার্থ আদায় করার জন্য। আমাদের দাবি নাফ নদী ও করিডোর খুলে দেওয়া জন্য।সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ, কোনো একটা ব্যবস্থা করা হোক।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: