• ঢাকা
  • বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

বাংলাদেশে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূলে করণীয়


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: রবিবার, ২১ আগষ্ট, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০১:৪৮ পিএম
ফিস্টুলা নির্মূলে অনেক পিছিয়ে আছি
প্রসবজনিত ফিস্টুলা

ডাঃ সিরাজুম মুনিরা

একজন সুস্থ মা দেশ ও জাতি গঠনে একটি বড়ো ভূমিকা রাখতে পারেন। প্রসবকালীন জটিলতায় সবচেয়ে গুরুতর ও বেদনা দায়ক যেসব ক্ষতি নারীর হয়ে থাকে, সেগুলোর একটি হলো প্রসবজনিত (অবস্টেট্রিক) ফিস্টুলা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে আনুমানিক ১ লাখ ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। প্রতি ১ হাজার বিবাহিত নারীর মাঝে ১ দশমিক ৬৯ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত। গত ২৩শে মে ইউএনএফপিএর কর্মসূচি, ক্যাম্পেইন টু এন্ড ফিস্টুলার আওতায় বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূল দিবস। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা এখনও ফিস্টুলা নির্মূলে অনেক পিছিয়ে আছি।

প্রসবজনিত জটিলতার কারণে মাসিকের রাস্তার সাথে মূত্রথলি বা মলাশয়ের এক বা একাধিক অস্বাভাবিক ছিদ্র হয়ে যুক্ত হওয়া। এর ফলে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রস্রাব-পায়খানা বের হয়ে যায়। বিব্রতকর গন্ধ এবং সার্বক্ষণিক ভেজাভাব স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাড়ায়।

বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসব বেদনার ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে জরুরি ও উন্নত চিকিৎসা না পেলে বাচ্চার মাথা যদি প্রসব পথে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকে তাহলে মূত্রনালী, প্রস্রাবের পথ এবং পায়ুপথের নরম অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পচন ধরে, ফলস্বরূপ ছিদ্রহয়ে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সৃষ্টি হয় এবং সাধারণত ডেলিভারির ৭-৮ দিন পর থেকেই অনবরত প্রস্রাব-পায়খানা ঝরতে থাকে। এমন অবস্থায় অধিকাংশ নারী মৃত সন্তান প্রসব করে। সিজার বা অপারেশনের মাধ্যমে শিশুর জন্ম, অন্য যে কোনো কারণে তলপেট, যোনিপথ বা জরায়ুতে অপারেশনের সময় অসাবধানতাবশত ফিস্টুলা হতে পারে। বাংলাদেশে অপারেশনেরজনিত ফিস্টুলার সংখ্যাও কম নয়, যা বর্তমানে ফিস্টুলার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। নারীদের জনেন্দ্রিয়ের ফিস্টুলার আরো কিছু কারণ আছে, যেমন- যৌন সহিংসতা, সড়ক দুর্ঘটনা, জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার, সংক্রমণ ইত্যাদি।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। সেগুলো হলো ভেসিকো- ভ্যজাইনাল ফিস্টুলা (Vesico-Vagainal Fistula)- এটি মূত্রাশয় এবং যোনিপথের মাঝে সংঘটিত হয়। ইউরেথ্রো-ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা (Urethro-Vaginal Fistula)- এটি মূত্রনালী এবং যোনিপথের মধ্যে হয়ে থাকে। রেক্টো-ভ্যাজাইনাল ফিস্টুলা (Recto-Vaginal Fistula)- মলদ্বার এবং যোনি পথের মধ্যে হয়ে থাকে।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা প্রতিরোধযোগ্য, ফিস্টুলা নির্মূলে প্রতিরোধই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবকালে সব নারীর পাশে দক্ষ সেবাদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং প্রসবজনিত জটিলতায় জরুরি সেবা দেওয়ার মাধ্যমে সার্বজনীন মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা ও ফিস্টুলা প্রায় নির্মূল করা যেতে পারে। বাল্যবিবাহের অবসান ঘটিয়ে এবং মেয়েদের প্রথম গর্ভধারণের সময়টা পিছিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রসবজনিত ফিস্টুলার হার কমানো সম্ভব। নারীদের পরিবার পরিকল্পনার সেবার আওতায় আসার সুযোগ দেওয়া এবং তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে অধিকার নিশ্চিত করা। প্রসবজনিত ফিস্টুলা টিকে থাকা মানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।

স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অবকাঠামোর উন্নয়ন, দ্রুতগামী পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কর্মীদের
উপস্থিতি জরুরি। যে কোনো অপারেশন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করা উচিত। আর্থসামাজিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন সবচেয়ে প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীসহ সবাইকে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে হবে। দেশব্যাপী সব সম্প্রদায়ের নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, যাতে পরিবারের অবহেলার শিকার না হতে হয়।

সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষকে ফিস্টুলা প্রতিরোধের উপায় এবং বর্তমানে প্রচলিত চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। অনেক নারী সঠিক চিকিৎসা নিয়ে ফিস্টুলা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিটি ফিস্টুলা এডভোকেট হয়ে রোগটির ঝুঁকি ও চিকিৎসা সম্পর্কে প্রচার চালাতে এবং সচেতনতা বাড়াতে পারেন। একটি তথ্যের প্রচার দরকার- প্রসব বেদনা ওঠার ১২ ঘণ্টার মধ্যে সন্তানের জন্ম না হলে গর্ভবতী নারীকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। বাড়িতে নয়, নিকটস্থ হাসপাতালেই ডেলিভারির জন্য উত্তম স্থান। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সরকার ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ এর টেকনিক্যাল সহায়তায় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলা মুক্ত করার একটি বড়ো উদ্যোগ নিয়েছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ এর সহায়তায় প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূলের দ্বিতীয় কৌশল পত্র প্রণয়ন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায়ঃ- ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রশিক্ষিত
মিড-ওয়াইফ নিয়োগ করা হয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটি ক্লিনিক এর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয় ২০ বছর এর আগে সন্তান ধারণ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির হার বাড়ানো ও সিজারিয়ান ডেলিভারির সংখ্যা কমানোর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে বিনামূল্যে দক্ষ ধাত্রী প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস সাপোর্টেড সাইটের মাধ্যমে ফিস্টুলা রোগীদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে আনা থেকে শুরু করে সব ধরনের চিকিৎসা ব্যয় বহন করা হয়। প্রসবজনিত ফিস্টুলার চিকিৎসা কি? আমি কবে শুকনো বিছানায় শুতে পারব? ফিস্টুলা রোগীদের কাছ থেকে এমন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়তই। কারণ একজন ফিস্টুলা রোগীর অনবরত প্রস্রাব ঝরতে থাকে। প্রসবজনিত ফিস্টুলার ভুক্তভোগী একজন নারীর মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
সম্পর্কের উন্নয়ন করা, সহানুভূতিশীল আচরণ করা কথিত বিশ্বাস আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের করে নিয়ে আসা এবং তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা অত্যন্ত জরুরি এবং তাকে বোঝাতে হবে যে, প্রসবজনিত ফিস্টুলার চিকিৎসা সম্ভব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার করে ফিস্টুলা সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব। এখানে যোনিপথ ও প্রস্রাবের পথকে আলাদা করে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানটি অপারেশন এর মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এই জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার কে সেন্টার অফ এক্সিলেন্স হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। ইউএনএফপি এর সহায়তায় বর্তমানে প্রায় ১০ টি সরকারি মেডিকেল কলেজে বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। এছাড়াও আরও সাতটি বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান ফিস্টুলা নিরাময়ে বিশেষ সেবা দিয়ে থাকে। যেমনঃ হোপ ফাউন্ডেশন, ল্যাম্ব হসপিটাল, ম্যামস ইনস্টিটিউট, কুমুদিনী হাসপাতাল, আদদ্বীন হাসপাতাল, ইত্যাদি।

যদি ফিস্টুলা হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায় তখন বিনা সার্জারিতে এন্টিবায়োটিক দিয়ে এবং মূত্রথলিতে কয়েক সপ্তাহ catheter দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারের ফিস্টুলা ভালো করা সম্ভব। ফিস্টুলা অপারেশন জটিল এবং দক্ষ সার্জনরাই এই অপারেশন করতে পারে। ফিস্টুলা সারাতে অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় রোগীদের পরামর্শ ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন। এতে ওই নারীরা সমাজের সঙ্গে আবার নিজেদের যুক্ত করে, নতুন করে জীবন শুরু করার মর্যাদা ও আশা ফিরে পান।

অবস্টেট্রিক ফিস্টুলার চিকিৎসা না নিলে তা থেকে নানান ধরনের শারীরিক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হতে পারে। যেমনঃ যোনি পথে চুলকানি, ক্ষত, বারবার মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ, স্নায়বিক ক্ষতি (ফুট ড্রপ, হাটার সমস্যা) শারীরিক মিলন ও সন্তান ধারণে অক্ষমতা, কিডনিতে পাথর, ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাবের ফলে নিদ্রাহীনতা অবসন্নতা ইত্যাদি। সেই সঙ্গে সামাজিক লজ্জা প্রায় সময় নারীদের বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়, ফলে তারা পরিত্যক্ত হয়ে পরেন। অনেক ক্ষেত্রে এই সমস্যা আক্রান্ত নারীদের তালাক দিয়ে দেন তাদের স্বামীরা। পরিবার ও সমাজও তাদের আলাদা করে দেয়। এতে ওই নারীরা আরও বেশি করে দারিদ্র্যের কবলে পড়েন।

প্রসবজনিত ফিস্টুলাকে তাই প্রায়ই একটি লুকানো যন্ত্রণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা নারী ও তাদের পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে। ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারীরা এই সমস্যাটি নিয়ে লজ্জিত থাকেন এবং এ নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না তাদের ভোগান্তি টা আড়ালে রয়ে যায়। এসবের জন্য অনেকে নিজেকে অপরাধী মনে করে, তারা মনে করে এটি তাদের কোনো পাপের ফল। অনেক নারী এই দুর্বিষহ জীবন সহ্য করতে পারে না, পরে এমনকি আত্নহত্যার পথও বেছে নেন।

আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে পারি, বাংলাদেশ সরকার মাতৃস্বাস্থ্যে অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেছে এবং এই কৃতিত্বের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এখন সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ সবার সহযোগিতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের সমস্ত ফিস্টুলা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় এনে ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলা মুক্ত করা সময়ের দাবি। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে প্রসবজনিত ফিস্টুলা এমন একটি সমস্যা যা একজন নারীকে সার্বক্ষণিক শারীরিক ও মানসিক কষ্টের পাশাপাশি তাকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অনেক সময় তারা জীবিত থেকেও মৃত। তাই তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রতিটি সচেতন নাগরিকের কর্তব্য।


লেখক- সিভিল সার্জন বাংলাদেশ সচিবালয় ক্লিনিক, ঢাকা

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image