• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৫ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ; ৩০ মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

ক্ষুদ্র মশা মহাবিপদে ফেলেছে: মুক্তি কিসে?


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, ০৭:৩৫ এএম
এডিস মশা
ছবি: এডিস মশা।

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: ছোট্ট মশার কি দারুন এক ক্ষমতা! ছোট্ট এডিস মশা গোটা জাতিকে সংকটে নিপতিত করেছে। তারা আমাদেরকে বর্তমানে এক মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এডিসের ডেনভি-৩র দাপটে দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে দিনাতিপাত করছে। বিসিএসআইআর এক গবেষণা রিপোর্টে বলেছে, ২০১৯-এ ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের শকে যাওয়ার হার কম ছিল এবং ৫ থেকে ১০ শতাংশ শিশুরা শকে যেত। ২০২১ সালে এসে শকে চলে যাবার হার ৩০ তেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শিশুদের দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। একদিকে করোনা, বৃষ্টি, বন্যা, নদীভাঙ্গন অপরদিকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের আহাজারি ও আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারে প্রাণপ্রিয় শিশুদের মৃত্যুভয়। এমন বাজে সংকটের মুহূর্ত আমাদের দেশে দীর্ঘদিন দেখা যায়নি, আঘাতও হানেনি!

ইতো:পূর্বে নানা ধরনের মহামারী যেমন কলেরা হতো, গুটিবসন্ত দেখা দিত, ঘন ঘন ডায়রীয়া হতো। সেই আতঙ্কের দিনগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি। এছাড়া ভয়ংকর ছয়টি শিশুরোগকেও আমরা দুরে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়েছি। জ্বর, পেটের পীড়া ইত্যাদি আমাদের মত গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশে অতি সাধারণ ব্যাপার। এগুলো হলে কেউ সাধারণত: মারা যান না। তাই প্যারাসিটামল বা খাবার স্যালাইন নিজে নিজে সেবন করার রেওয়াজ ঘরে ঘরে সমাদৃত। কয়েক বছর ধরেই এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গিজ্বরের প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হলেও মৃত্যুহার তেমন না থাকায় সেটাকে একদম অবহেলা করা হয়েছে। যদিও ভারত, থাইল্যান্ড, ফিলিপিনস্ প্রভৃতি দেশে ডেঙ্গিজ্বরের জন্য বিশেষ সতর্ককতা অবলম্বন করা হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে মোটেও গুরুত্ত্ব দেয়া হয়নি। মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি সবার নজর কেড়েছে। 

আমাদের দেশে ২০০০ সালে প্রথম শুরু হওয়া ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আমাদেরকে ঊনিশ বছর সময় দিয়েছিল এডিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিন্তু তা না করে রাজধানীকে দালানের বস্তি ও ময়লার ভাগাড় বানিয়ে অবহেলায় সময় পার করে দিয়েছি আমরা। তাইতো ২০১৯ সালে এডিসরা রাগ করে মরণ কামড় বসিয়ে দেয়। ঘটায় ডেঙ্গুর আক্রমণে সর্বচ্চো মৃত্যু। তখন শিশু, স্কুলছাত্র, অন্ত:স্বত্তা গৃহবধূ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী, পুলিশের বড় কর্মকর্তার স্ত্রী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ বহু প্রাণ ডেঙ্গুজ্বরের কারণে ঝরে গেছে। ২০২১ সালে এসে মনে হচ্ছে করোনার আক্রমণের সাথে একসংগে যুক্তি করে বাসা-বাড়ি, শিক্ষাঙ্গন, অফিস-আদালত, রাজনৈতিক অঙ্গন, হাসপাতাল সবজায়গায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। এবারে শুরু করেছে শিশুদেরকে আক্রমণের শিকার করার মাধ্যমে। এবছর পত্র-পত্রিকা তো বটেই, টিভি রুমের আলোচনায় ডেঙ্গুজ্বরের কথা নানাভাবে প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরের আলোচনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপবাদ দেয়ার খেলাও (ব্লেম-গেম) বেশ জমে উঠেছে। মনে  হচ্ছে এটাই আমাদের জাতিগত কৃষ্টির চরিত্র। সমস্যাটির সমাধানের দিকে নজর নেই, এক অপরকে দোষারোপ করে কালক্ষেপণ করে বিষয়টিকে আরো খারাপের দিকে ঠেলে দেয়াটা যেন আমাদের কাজ।

ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না- রোমানরা যখন ইউরোপ জয় করে তখন সেখানে জৌলুষ ছিল। কিন্তু সৈন্যদের দুর্নীতি, লুটতরাজ, বিলাসিতা, অহমিকা ও কাজকর্মে অনীহা থেকে সামাজিক অনাচার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মাদকদ্রব্য আফিমের ব্যবহার বেড়ে যায়। কাজ-কর্মে চরম অবহেলা ও নোংরামীর কারনে আবর্জনার স্তুপ জমে উঠে। চারদিকে ময়লা আবর্জনা ও ভাগাড়ের কারনে ইঁদুরের বংশ ও বসতি বেড়ে যায়। আমদানী বেড়ে যওয়ায় যুদ্ধ জাহাজের পাশাপাশি বাণিজ্য জাহাজ চলাচলের ফলে নাবিকদের বাক্স-পেটরা ও পণ্যসামগ্রীর প্যাকেটের মাধ্যমে প্লেগের বাহন কালো ইঁদুর সারা ইউরোপে বংশ বিস্তার করে ফেলে। এরা প্রথমদিকে ফসলের খামারেই থাকতো। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিলের সময় আইরিশ পটেটো ব্লাইট ও ফ্যামিনের কথা সর্বজনবিদিত। মড়ক রেগে আলুর আবাদ নষ্ট হয়ে গেলে ইউরোপে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইঁদুররা একসময় ফসলের জমির শস্যদানা শেষ করে ফেললে খাবারের অভাবে মানুষের বসতিতে ঢুকে আক্রমণ শরু করে। সেখান থেকে প্লেগ ছড়াতে থাকে ও আতঙ্ক শুরু হয়। মহামারী আকারে প্লেগ শুরু হলে শহরের মানুষ দিক্বিদ্বিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে এক সময় শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিল। শহরগুলো তখন ভুতুড়ে অন্ধকার জনপদে রুপান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ফরাসী বায়োলজিষ্ট আলেক্সান্ডার ইয়ারসিন প্লেগের জীবাণু আবিষ্কার করলে এর প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফলে অবস্থার উন্নতি হয়। কিন্তু সেই সামাজিক ক্ষত এখনও ইতিহাস হয়ে আমাদেরকে উপহাস করে মাত্র।

অর্থাৎ, মানুষের অবহেলা ও উদাসীনতাই এই মহামারীর জন্য দায়ী। এডিস মশা এক দুই করে মানুষের প্রাণ সংহারে নমে পড়েছে বিধায় আমরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছি। এতদিন এর প্রতিরোধে অবহেলা করা হয়েছে। আজ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে দেশে ২৪ ঘন্টায় সর্বচ্চো নতুন করে ৩৫৭ জন ডেঙ্গি রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হবার সংবাদ বের হয়েছে। এ বছর সারা দেশে এ পর্যন্ত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে যা খুবই আতঙ্কের বিষয়। সারা দেশে ২৭ হাজার ৪৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। করেনায় ঘরবন্দী মানুষেরা লকডাউন খুলে দেবার পর বেপরোয়া চলাচল করছে। ঢাকায় হঠাৎ করে মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সংবাদে মানুষের চলাচলের গতি বেড়ে গেছে। গণপরিবহণ চলাচল শুরু করায় ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অথচ, ঢাকার বাইরে এর চিকিৎসা সুবিধা খুবই সীমিত।

প্রশ্ন হলো এই মহাবিপদের মুক্তি কোথায়? সবাই রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে সবার জন্যই শুধু বিপদের ক্ষেত্রটা প্রশস্থ হবে। সরকার এখনো ডেঙ্গুর ভয়াবহতাকে সেভাবে প্রকাশ করছেন না। প্রতিদিন এত মানুষ, এত শিশু আক্রান্ত হচ্ছে তবুও সরকার কেন ডেঙ্গুকে মহামারী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সারা দেশের মানুষকে সতর্ক করছেন না সেটা মোটেই বোধগম্য নয়। মানুষের ভীতি কাটানোর জন্য ও সতর্কতা বাড়ানোর মাধ্যমে এর প্রতিরোধ করার জন্য সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। সরকারী তথ্য সেল খুলে ডেঙ্গু কোন লেভেলে আছে তা বিরতিহীনভাবে সকল রেডিও-টিভি ও পত্রিকায় জরুরীভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে হাস্যকর পদক্ষেপ যেমন- পিচঢালা রাস্তায়, জনসভায় দুপুরের রোদে ফগিং করা হচ্ছে। অথচ, এডিসের জন্মস্থান বাসার কাছে জমানো পরিস্কার পানিতে, চৌবাচ্চায়, ছাদবাগান, ফুলের টবে, নির্মাণাধীন বাড়ির জমানো পানি, পরিত্যক্ত পনির পিপা-ড্রাম, ড্রেন, বাসন, ডাবের খোসা, পলিথিন, বেসিন ইত্যাদিতে। এজন্য সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কেউ কেউ বলছেন, এডিস মশা পানিতে ডিম পাড়েনা। তা বটে, তবে তারা ময়লা পানিতে মি পাড়ে না। পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। শত শত ছাদবাগানে নিয়মিত পরিষ্কার পানি ব্যবহার করা হয় ও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাষণের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো বড়টব, পাত্র, ড্রাগণ ফলের জন্য ব্যবহৃত টায়ার প্রভৃতিতে জমা থাকে। সেই পরিষ্কার পানিতে এডিসরা ডিম পাড়ে। মা এডিসরা গাছের পাতায় লুকিয়ে থাকে। অপরিচ্ছন্ন ছাদবাগানে দিনের বেলাতেই মানুষকে কামড়ায়। এ ব্যাপারে সঠিক তথ্যও জনগণকে জানানো প্রয়োজন। কীটনাশকে এডিস তেমন মরে না। তাই ছাদবাগান সৃষ্টির ব্যাপক প্রবণতাকে এবছর এডিসের প্রকোপ না কমার প্রধান কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।
 
ডেঙ্গুর একমাত্র বাহক এডিস মশা। ফলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ওপরই নির্ভর করবে কোন বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে। কীটতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন কিছু নয়। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ সহজ। কারণ, এডিস মশা পাত্রে জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়ে। এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল। ফলে কীটনাশক দিয়ে এর নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়” (প্রথমআলো ০৯.০৯.২০২১)।

ডেঙ্গুর প্রকোপ আজ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলগামী বাচ্চাদের সাথে বাবা-মা ও অভিাবকরা দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই সবার দু:শ্চিন্তা কমাতে এবং সার্বিক নিরাপত্তার তাগিদে আসন্ন স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা খোলার সাথে সাথে ব্যাপক হারে সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। এডিসরা দিনের বেলাতেও কামড়ায়। তাই শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘিঞ্জি এলাকার স্কুল কলেজ হলে জানালা বন্ধ করে মশার সঠিক ওষুধ স্প্রে করার ব্যবস্থা করতে হবে।

শহুরে ধনী ডেঙ্গু রোগীরা সহজে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন কিন্তু গরীব মানুষেরা যাতে সহজে চিকিৎসা পেতে পারেন সেজন্য দানশীল ব্যক্তিগণকে এ মুহুর্তে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হবে।  ছোট্ট এডিস মশা গোটা জাতিকে আজ যে মানবিক সংকটে নিপতিত করেছে তার জন্য আমাদেরকে মনে প্রাণে পরিচ্ছন্ন হতে হবে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ফেলে নিজে নোংরা থেকে মুক্ত থাকি, পরিবেশকে নোংরা হতে না-দিই। তাহলে এডিস মশারা লজ্জায় পালিয়ে যাবে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

ঢাকানিউজ২৪.কম / মো: জাহিদুল ইসলাম জাহিদ।

আরো পড়ুন

banner image
banner image