• ঢাকা
  • শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

‘মধুসূদন-প্রতিভার স্বরূপ সন্ধানে রানা


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: রবিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৮:৪৯ পিএম
মাইকেল ছন্দ ভাঙলেও সেই সময় সমাজ তো
মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মাইকেল মধুসূদন দত্তের গোটা জীবনটাই একটা নাটক ছিল। বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্কট-কালে তিনি দেখা দিয়েছিলেন বলে তাঁর জীবনেতিহাসেও একটা সঙ্কট দেখতে পাওয়া যায়, সেটা হল তাঁর মানসিক সঙ্কট। ওই সময়ে বাইরে দেশকালের মধ্যে ভাবধারার যে জটিলতা ও বিক্ষুব্ধি ছিল, কবির মনোভূমিতে সেটার প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে, কপোতাক্ষ তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে যে ছোট কপোতটি জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে আর কিছু না থাক, আত্মবিশ্বাসীর দুরন্তপনা অবশ্যই ছিল। নিজের গোটা জীবনে তিনি কখনও শান্তি চাননি, স্বস্তি চাননি, স্বাচ্ছন্দ্যও চাননি; তিনি শুধু আত্মপ্রত্যয়ের জোরে আমরণ ভেসে চলতে চেয়েছিলেন। তাইতো তাঁর অস্থির জীবনের কল্লোল থেকে থেকে শোনা গিয়েছিল।

নিজের অশান্ত মনোধর্মের তাড়না নিয়ে তিনি নয় বছর বয়সে কলকাতায় পদার্পন করেছিলেন, কিন্তু সেখানে গিয়েও তাঁর মন স্থিব হয়নি। এরপরে হিন্দু কলেজ ও বিশপস কলেজ তাঁর মনের ওপরে ছায়া ফেলতে শুরু করেছিল, ফলে এক অস্থিব আবেগ তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। সাগর পাড়ের শ্বেতদ্বীপ তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। তাই পিতামাতার স্নেহের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ভেঙে দিয়ে, অজানা পথের শঙ্কা বরণ করে নিয়ে তিনি খৃষ্টান হয়েছিলেন - যিশুর প্রতি ভক্তিবশতঃ নয় - এক নতুন জীবনের-সুধা আকণ্ঠ পান করবে বলে, একজন ‘মানুষের মত মানুষ’ হবেন বলে, বিলেত গিয়ে একজন বড়ো কবি হওয়ার সুযোগ পাবেন বলে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। বিজাতীয় ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরে ইংল্যাণ্ডই তাঁর স্বপ্নের দেশ হয়ে উঠেছিল।
“And oh! I sigh for Albion’s strand
As if she were my native land!”

অতএব মধুসূদন মাতৃভূমি থেকে ছিন্নমূল হয়েছিলেন, নতুন জন্মের জন্মভূমির অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। সবাই বুঝেছিলেন যে, তিনি জীবনে একটা কিছু চান। সেটার জন্য নিজের সর্বস্ব পণ করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। নিজের ব্যবহারিক জীবনে তিনি ইয়ং বেঙ্গলের একজন হয়ে স্পষ্টতঃই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিলেন, বিজাতীয় সমস্ত কিছুর প্রতিই ভক্তির প্রাবল্যে তিনি স্নবের পরিচয় দিতে ইতস্ততঃ করেন নি। কিন্তু তাঁর বাইরের জীবনের সেই সর্বগ্রাসী উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে, বিমূঢ়তার মধ্যে একটা অন্তর্জীবনও ছিল। তাঁর সেই জীবনে বিদ্যাদায়িনী ও কাব্যলক্ষ্মীর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, তাই বাইরেব ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও তাঁর অন্তরের দেবীর পূজায় কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। বড়ো কবি হওয়ার স্বপ্নটানে তিনি তখন পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যের সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। হিন্দু কলেজে ইংরেজী ও পারসী, এবং বিশপস কলেজ গ্রীক ও ল্যাটিন শিখেছিলেন। মধুসূদনের মাদ্রাজ প্রবাস নিয়ে কোথাও তেমন আলোচনা পাওয়া যায় না, অথচ তাঁর জীবনে মাদ্রাজ প্রবাসের গুরুত্ব অনেক। যে বিপুল আশা নিয়ে তিনি খৃষ্টান হয়েছিলেন তার মধ্যে ধীরে, অতি ধীরে ভাঙন ধরেছিল; খৃষ্টান হলেই জীবনের যা কিছু কাম্য তা পাওয়া যায় না, এই উপলব্ধি তাঁর মধ্যে জাগতে শুরু করেছিল।

মাদ্রাজে মধুসূদনের জীবন নিরবচ্ছিন্ন সুখের ছিল না, সেখানে বহু আয়াস ও পরিশ্রমে তাঁকে অন্নসংস্থান করতে হয়েছিল। এক কথায়, মাদ্রাজে থাকবার সময় থেকেই স্নব মধুসূদনের স্বপ্নের জগৎ একটু একটু করে ভাঙতে আরম্ভ করেছিল। ওই সময়ে তাঁর যৌবনের স্বপ্ন-বঙীন দিনে কবির চোখে যে প্রিয়া - “oh! beautiful as Inspiration when she fills the poet’s breast” - মধুসূদনের জীবনে তিনি প্রথমে এসেছিলেন কিনা সঙ্কীর্ণমনা ‘রেবেকা’ বেশে! পুরুষ, কবিপুরুষ নারীর কাছে প্রাণ-পিপাসায় যে সুধা চায়, রেবেকার কাছে সাফোর-ভক্ত মধুসূদন তা পাননি। এরপরেও কি তাঁর স্বপ্ন না আর ভেঙে পারত? দ্বিতীয়তঃ, ওই সময়ে তিনি ইংরেজী কাব্য লিখেছিলেন, ভালোই লিখেছিল - অথচ রসজ্ঞ ইংরেজ মনীষী ‘বেথুন’ সাহেব তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, বিদেশী ভাষায় কাব্য লিখলে তাঁর কোন উপকার হবে না, বরং মাতৃভাষায় কাব্য লিখলে তাঁর প্রতিষ্ঠা অনিবার্য। অর্থাৎ, খৃষ্টান হওয়ার সময়ে মধুসূদনের যে দুটি স্বপ্ন ছিল - তিনি একজন অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ও উচ্চস্তরের ব্যক্তি হবেন, আর ইংরেজী ভাষার একজন কবি হবেন - সেই দুই স্বপ্নেই মাদ্রাজ প্রবাস কালে আঘাত এসেছিল, তারপরে আঘাতে আঘাতে বাস্তবের সাক্ষাতে তাঁর চোখ খুলতে শুরু করেছিল। আবার সেই সময়েই বিধাতার আশীর্বাদের মতো তিনি তাঁর সতী-সাধ্বী দ্বিতীয়া স্ত্রী ‘আঁরিয়েৎ’ বা ‘হেনরিয়েটা’কে লাভ করেছিলেন। তাঁর অশান্ত বিক্ষুব্ধ জীবনে সেই নারী স্নিগ্ধ প্রলেপ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন, হয়তো জীবনের অন্তর্নিহিত মাধুর্যের আস্বাদ ও তাৎপর্যের সন্ধানও ওই সময়েই তিনি পেয়েছিলেন।

সত্যি কথা বলতে কি, মধুসূদনের মাদ্রাজ প্রবাস-কাল তাঁর স্বপ্নভাঙার কাল ছিল, অন্ততঃ কিছু পরিমাণে আত্মস্থ ও স্থিতধী হওয়ার কাল ছিল। যদিও কোন কোন সমালোচক অন্য কথাও বলে থাকেন। কলকাতা থাকতেই মধুসূদন দিশি ভাষা ও সাহিত্যকে নিঃশেষে ত্যাগ করে ইংরেজী ও পাশ্চাত্য বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল ভাষা ও সাহিত্যেব রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি নাকি প্রকাশ্যে মাতৃভাষার নিন্দা করে বেড়াতেন। মাদ্রাজে প্রথমাবস্থায় সেটারই অনুবৃত্তি চলেছিল; সেই সময়ে তাঁর লেখা একটি চিঠি থেকে হিব্রু, গ্রীক, তেলেগু, সংস্কৃত, ল্যাটিন এবং ইংরেজী পাঠে তাঁর নিত্যকার অধ্যবসায়ের কথা জানতে পারা যায়। ওই সময়ে সীতাকে নিজের একটি রচনায় তিনি ‘অসতী’ (faithless) বলতেও ইতস্ততঃ করেন নি, ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পাদটীকায় রামায়ণ ও পুরাণ সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া যায়।  মাদ্রাজে থাকবার সময়েই তিনি আরেকটি চিঠিতে বাঙলা দ্রুত ভুলে যাচ্ছেন বলে ‘গৌরদাস বসাক’কে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ মাদ্রাজ প্রবাস মধুসূদনের পক্ষে দেশ, দেশের সাহিত্য ও দেশেব সংস্কৃতিকে অস্বীকারের কাল ছিল। কিন্তু অনেকেই আবার এই মতের পরিপোষক নন। মাদ্রাজে দেশীয় খৃষ্টান সমাজ ছাড়া তিনি আর কিছুই পাননি, এবং মধুসূদনের জীবনী যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন তাঁরা নিশ্চই বিশ্বাস করবেন যে, এই দূরাভিলাষী ব্যক্তিটির স্বপ্ন তাতে অটুট থাকতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ, তখন পাশ্চাত্য বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ও তেলেগুও পড়ছিলেন - সেটি দেশের ভাষা ও সাহিত্যের দিকে তাঁর দৃষ্টি থাকবার উদাহরণ। তৃতীয়তঃ, গৌরদাস বসাকের কাছে মধুসূদন কাশীদাসী মহাভারত পড়বার আগ্রহ প্রকাশ করে সেটা মাদ্রাজে চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। চতুর্থতঃ, গৌরদাসকে লেখা চিঠিতে নিজের ভাষা শিক্ষার তালিকা উল্লেখের শেষে তিনি মন্তব্য করেছিলেন - “Am I not preparing for the great object of embellishing the tongue of my fathers?” সবচেয়ে বড় কথা হল যে, মাদ্রাজ প্রবাস-কাল মধুসূদনের স্বপ্নভাঙার কাল না হলে তিনি তারপরে কলকাতায় ফিরে এসে সার্থক সাহিত্যের সোনার ফসল ফলাতে পারতেন না। সীতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ও ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পাদটীকা আসলে স্নব ও উচ্চাভিলাষী মধুসূদন কর্তৃক বিদেশী পাঠক-পাঠিকাকে খুশি করবার একটা চেষ্টা মাত্র ছিল। ওই ধরনের ধাপ্পা বা স্নবারিব উদাহরণ মধুসূদনের জীবনেতিহাসে আরো অনেক পাওয়া যায়। তারপরে তিনি মাদ্রাজ থেকে পিতার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে তাঁর  সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সেই প্রাচুর্যের কুফল ফলবার আগেই তিনি তাঁর মাদ্রাজ জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে, নিজের মাথায় বিদ্যের বোঝা নিয়ে - ভেতরের কবি-পুরুষের তাগিদে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনা করে ফেলেছিলেন। বস্তুতঃ, সেটাই ছিল মধুসূদনের জীবন-নাট্যের প্রকৃষ্ট সময়। কারণ, ব্যবহারিক জীবনে যে দুঃখবেদনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এক কথায় যে ট্র্যাজেডি মাদ্রাজে তাঁকে সুখী হতে দেয়নি - পৈতৃক সম্পত্তির উদ্ভবাধিকার, পুলিশ কোর্টের চাকরি, আর্থিক সচ্ছলতা ও মানসিক শান্তি সেসবের অবসান ঘটাতে পেরেছিল।

তার কবিজীবনের সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের সামঞ্জস্য আসবার ফলে তাঁর অস্থির জীবনের পুনর্বাসন ঘটেছিল। যে কোন সৃষ্টির জন্যই যে স্থিতি ও শান্তি অত্যাবশ্যক, মধুসূদনের মন তখন সেটার নাগাল পেয়েছিল। কবি তখন আত্মস্থ হয়েছিলেন। আর বাঙলার সমাজের মাহেন্দ্রক্ষণও সেই সময়েই এসেছিল (১৮৬০ খৃষ্টাব্দের আগে অথবা পরে)। বিধবা-বিবাহের আন্দোলনে, নীলকর-বিরোধী আলোড়নে, দেশীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনায়, নববিধান ব্রাহ্মসমাজেব অভ্যুত্থানে - তৎকালীন বাংলায় একটা সামাজিক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এমনি এক শুভদিনে, বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের দিনে মধুসূদনের বাঙলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটেছিল, সেটাকে বিস্ময়কর আবির্ভাব বললেও ভুল কিছু বলা হবে না। কিন্তু কবির সেই সৃষ্টিশীলতাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, পৈতৃক সম্পত্তির সংস্পর্শে ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার আস্বাদনে তাঁর ভেতরকার স্নব মানুষটি আবার জেগে উঠেছিল। অপব্যয়ে ও অমিতব্যয়ে তিনি নিজের জীবন কাটতে শুরু করেছিলেন, বিদেশে যাবাব স্বপ্নে তিনি আবার অস্থির অশান্ত হয়ে উঠেছিলেন। অর্থ-চিন্তা তাঁর ভেতরকার কবি মানুষটিকে ধ্বংস করেছিল; সাহিত্যেব পবিত্র পূজায় তাঁর অবহেলা মানসিক তপশ্চর্যা ঘটিয়েছিল। এরপরে ব্যারিস্টার হওযার জন্য তিনি বিলেত যাত্রা করেছিলেন। আর সেই যাত্রার ফল বিভীষিকাময় হয়েছিল। অনিদ্রায় অনাহারে বিদেশে তাঁকে নিজের দিন কাটাতে হয়েছিল, সেখানে শক্ত করে ধরবার জন্য কোন খুঁটিই তিনি খুঁজে পাননি। এর আগেও তাঁর জীবনে দুঃখ এসেছিল, অভাব এসেছিল - কিন্তু তখনও তিনি অমন ভাবে ভেঙে পড়েন নি; তখন সংসারের টানা-পেড়েনের হাত থেকে আপন শক্তিবলেই তিনি আপনাকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু বিদেশে যখন দুঃখের আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তাক্ত হয়েছিলেন, তখন বিদ্যাসাগরের দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে, এবং সমস্ত সম্ভাব্য সাহায্য সত্ত্বেও শান্তির আশ্রয় ও স্বস্তির কোন অবলম্বন পাননি। ততদিনে তিনি প্রায় সব খুইয়ে বসে ছিলেন, নিজের মনের দিক থেকে তিনি তখন দ্রুত দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিলেন, কাব্যলক্ষ্মীর ঝাঁপি ভরিয়ে তোলবার শক্তি-সামর্থ্যটুকুও তিনি তখন হারিয়ে ফেলেছিলেন।

মধুসূদন তখন বাইরের দিক থেকে যেমন, ভেতরের দিক থেকেও তেমনি নিঃস্ব রিক্ত সর্বহারা হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও মাঝে মাঝেই তিনি জানাচ্ছিলেন বটে - আমি অবিশ্রান্ত পড়ে যাচ্ছি, শিখে যাচ্ছি - কিন্তু তখনকাব সমস্ত জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সেই উক্তিগুলিকে আত্ম-ছলনার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু বলে মনে হয় না। সেটা যেন নিজেকে ভুলিয়ে রাখবার জন্য তাঁর নিজের একটা অসামান্য প্রয়াস ছিল। এমনি দিনে মধুসূদনের বারে বারে তাঁর মাতৃভূমির কথা মনে পড়েছিল - যে মাতৃভূমি শুধু মৃন্ময় নয়, চিন্ময়ও বটে। সেই কপোতাক্ষ নদ, অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, নদীতীরের দ্বাদশ শিবের মন্দির, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, জয়দেব, ইত্যাদি স্বপ্নে জাগরণে তাঁকে হনন করতে শুরু করেছিল। কিন্তু, হায়! বিমূঢ়তায় তিনি যে তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন; সেখান থেকে ফেরবার পথ আর ছিল কোথায়? তাই চতুর্দশপদীতে শেষবারের মতো মধুসূদনের কবিকণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠেছিল - মাতৃভূমিকে তিনি তাঁর রক্তাক্ত হৃদয়ের সর্বশেষ নমস্কার, সর্বশ্রেষ্ঠ নমস্কার জানিয়েছিলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মধুসূদনের মধ্যে এক অশান্ত হৃদয়াবেগ ও অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল। সাগরদাঁড়ি থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে বিলেত, বিলেত থেকে ভারতবর্ষকে তিনি পেতে চেয়েছিলেন; একটিকে তিনি যখনই পেয়েছিলেন, তখনই আরেকটির জন্য তাঁর মনে আকুলতা জেগে উঠেছিল। তাঁর মন যে কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে চায়নি, দাঁড়াতে পারেনি - সেটার কারণ ছিল যুগ-পরিবেশ।

সমাজে তখন নতুন জোয়ার-জল এসেছিল, সেই জোয়ারে মধুসূদন আত্মরক্ষা করতে পাবেন নি, অবশ্য তিনি আত্মরক্ষা করতেও চাননি; কারণ, তাঁর ব্যক্তিপুরুষেরও অস্থির ধর্ম ছিল। তখন কালের বুকে নিশ্চই আবর্ত জেগেছিল, আর সেই আবর্ত মধুসূদনের জীবনের তটেই ভেঙে পড়েছিল। আজও সম্বাদ-প্রভাকরের পৃষ্ঠা ঘাঁটলে সেকালের পিতার আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায় - “ওরে আমি কি ঝকুমারি করো তোরে হিন্দু কলেজে দিয়েছিলাম যে তোর জন্য আমার জাতিকুলমান সমুদয় গেল!” কিন্তু তখন হিন্দু কলেজে পড়লেই ছেলেরা উচ্ছঙ্খল হতেন, একথাই বা বলা যায় কি করে? মধুসূদনের হিন্দু কলেজের সহপাঠী ছিলেন ‘রাজনারায়ণ বসু’ ও ‘ভূদেব মুখোপাধ্যায়’। তাঁদের মধ্যে একজন গিয়েছিলেন রিফরমেসনের পথে, অন্যজন ঝুঁকেছিলেন রক্ষণশীলতার দিকে। আসল কথা হল, সমাজে তখন যে নতুন বন্যা এসেছিল, মধুসূদন সেটা থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাননি; কারণ, তাঁর মন কখনো নোঙর করতে শেখেনি। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর আত্মমহিমা বা ব্যক্তিত্ববোধ খুব প্রখর ছিল, তাই ইয়ং বেঙ্গলের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে তিনি কোন কুন্ঠাবোধ করেন নি। কারণ, ইয়ং বেঙ্গল, গভীরতর দৃষ্টিতে, ব্যক্তিতন্ত্রের উপাসক ছিল না কি? এবং তাতে উচ্ছ্বাস ও স্বেচ্ছাচারিতা, অতিসাহস ও স্পর্ধা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। মধুসুদন আপন ব্যক্তিত্ববোধের তাগিদে রাজনারায়ণ-জাহ্নবীর স্নেহের ফাটল দিয়ে যুগের ঝড়ো হাওয়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া অতি অল্প বয়সে, ‘গ্যেটের’ চেয়েও কম বয়সে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি কবিত্ব-প্রতিভা নিয়েই জন্মেছেন, অসাধারণ একটা কিছু করবার জন্যই রাজনারায়ণের ছেলের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই উপলব্ধিটাও তাঁকে ঘর ছেড়ে বাইরে ছুটে যেতে প্রেরণা দিয়েছিল। ফলে মনে তাঁর শান্তি ছিল না, স্থৈর্য ছিলো] না, দৃঢ়তা ছিল না - তাঁর মানসিক ভারসাম্য কখনোই অটুট থাকে নি। একটা গভীর প্রত্যয় ছাড়া কারো জীবন কখনো দাঁড়াতে পারে না, একটি বিশ্বাসের শক্ত জমির ওপরে অন্তর্জীবন দাঁড় করাতে না পাবলে মানুষের চলে না। মধুসূদন নিজের গোটা জীবন ধরে সেই অপরিহার্য শক্ত জমি হারিয়ে ফেলে শুধুই অবিশ্রান্ত উড়ে বেড়িয়েছিলেন। বহু সংগ্রামেব শেষে সেই জীবন-পাখি যখন মাটি খুঁজে পেয়েছিল তখন বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই মধুসূদনের বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পরের দিনগুলি ছিল শুধুই অপচয়ের দিন, মৃত্যুর দিকে তাঁর ক্ষয় হয়ে যাওয়ার দিন। অতি বেদনাদায়ক সে ইতিহাস।

মধুসূদন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্রান্তিলগ্নের প্রতীকী-কবি। তাঁর কাব্যমূল্য মোটামটি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হলেও তাঁর ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকার কৌতূহল এখনও অতৃপ্তই রয়ে গিয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসার উৎস নিঃশেষিত না হয়ে চির-প্রবহমাণ। তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাই তাঁর সম্বন্ধে বিচিত্র ও বহুমুখী ধারাকে উন্মুক্ত রেখেছে। বিদেশীয় সাহিত্য ও দেশী সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় রহস্যের সূত্রটি তাঁর হাতেই বিধৃত। প্রায় দেড়শো-বছরের আধুনিক বাংলা সাহিত্যধারা যে পথে প্রবাহিত হয়েছে তাঁর রচনাই সেটার গতিপথ নির্ণায়ক। মধুসূদনকে সম্যক না বুঝলে, যে মানসচেতনা ও কল্পনাসমৃদ্ধির মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রাণরস ভারতীয় কবি-চিত্তের অন্তঃপ্রকৃতির অঙ্গীভূত হয়েছে, তার রহস্য অবিদিতই থাকবে। নতুন ও পুরাতনের এই অন্তরঙ্গ মিলন মধুসূদনের কবিপ্রতিভারই স্বীকরণশক্তির পরিচয় ও তাঁর পরবর্তীদের সাহিত্যকৃতির আদিম প্রেরণা। রামমোহনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “Inaugurator of Modern Age in India” - “ভারতে আধুনিক যুগের প্রবর্তক”। তেমনই মাইকেল মধুসূদন ছিলেন ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক। আধুনিক বাংলা সাহিত্য যে গরিমায় আজ বিশ্ব সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, মাইকেল মধুসূদনই সেটার সূচনা করেছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবসম্পদ ও আঙ্গিককে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে গ্রহণের পথ সর্বপ্রথম তিনিই দেখিয়েছিলেন। বিশ্ব সাহিত্যের মহাসমুদ্রকে মন্থন ক’রে অমৃত সংগ্রহের জন্যে প্রয়োজনীয় দৈবী ও দানবিক দুই শক্তিরই অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর শক্তি ছিল দৈবী, কারণ, তাতে ছিল অতুলনীয় নিষ্ঠা, সাধনা ও আত্মপ্রত্যয়; তাঁর শক্তি ছিল দানবিক, কারণ, তাতে ছিল শক্তির অতুলনীয় দম্ভ এবং গগনস্পর্শী উচ্চাশা। তিনি কেবল ইংরেজী, গ্রীক, লাতিন, ইতালীয়, ফরাসী, জার্মান ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সমুদ্রকে মন্থন করেন নি, ঐসব সাহিত্যের মহাকবিদের সমকক্ষ হওয়ার উচ্চাশা ও অহংকারও তিনি পোষণ করতেন। তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, ব্যাস ও বাল্মীকির রচনাকে কেবল আকণ্ঠ পান করেন নি; তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, ব্যাস ও বাল্মীকির সমকক্ষ হয়ে তাঁদের সমান আসনে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবার উচ্চাশা ও অহংকার পোষণ করতেন। তাই তিনি বাল্যকালেই তাঁর প্রিয় বন্ধুকে বলতে দ্বিধা করেন নি - “Oh! how should I like to see you write my ‘Life’, if I happen to be a great poet, which I am almost sure I shall be ...” নিজের কবিত্ব শক্তি সম্পর্কে দম্ভ ও তাঁর উচ্চাশা তিনি কৈশোরেই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। মধুসুদনের মধ্যে যে দৈবী ও দানবিক শক্তির মিলন ঘটেছিল, সেটাই তাঁকে একদিকে যেমন কবিত্বের উত্তঙ্গ গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি তাঁকে একদা দুঃখের অতল গহবরেও নিক্ষেপ করেছিল। তাঁর জীবনে যেমন ঐশ্বর্য ও ভোগবিলাসের রাজসিকতা, দৈন্য-দুঃখের চরম অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই দেখতে পাওয়া যায় দেবোপম বন্ধুপ্রীতি, পত্নীপ্রেম, সন্তান বাৎসল্য, ক্ষুরধার বুদ্ধি, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য - আবার এগুলোর সাথে দেখতে পাওয়া যায় চরম হৃদয় হীনতা, হঠকারিতা, ঔদাসীন্য, অবহেলা, নির্বুদ্ধিতা, অবিবেচনা, এমনকি স্বার্থপরতা। যে স্বর্গ ও নরকের মিলন ঘটেছে মর্ত্যলোকের সীমানায়, সেই স্বর্গ ও নরকের দুই কোটিকেই প্রত্যক্ষ করা যায় তাঁর জীবনে। তাই তাঁর জীবন আমাদের যেমন উল্লসিত করে, তেমনই পীড়াও দেয়৷ মধুসূদনের জীবন-আলেখ্য আলোকে, অন্ধকারে, ঔজ্জ্বল্যে, কালিমায় এমন পরিপূর্ণ যে, তাঁকে বৈপরীত্যের সমাবেশও বলা চলে।

হিন্দু কলেজের ছাত্র থাকবার সময়ে মধুসূদন রোমান কবি ওভিড-এর লেখা ‘এপিস্তুলাই হেরোইদুম’ বা ‘হেরোইদেস’ পড়েছিলেন; যেখানে গ্রিক পুরাণের নারীরা আবেগে-আশ্লেষে তাঁদের প্রেমিকদের চিঠি লিখেছিলেন। অমন কাব্য তখন বাংলায় ছিল না। তাই মধুসূদনের মনে হয়েছিল যে, ওভিড-এর অনুকরণে নতুন এক কাব্য লিখলে কেমন? সেখানে ভারতীয় পুরাণের নারীরা ‘প্রশ্ন-অভিযোগ-আহ্বান’ জানিয়ে চিঠি লিখবেন তাঁদের স্বামী অথবা প্রেমিককে। চিঠির আদল হবে ‘পৌরাণিক’, কিন্তু অন্তরে থাকবে ‘সমকালের স্বর’। নিজের মাথায় ঘুরতে থাকা সেই পরিকল্পনা তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাককে তখনই জানিয়েছিলেন। এর বেশ কয়েক বছর পরে মধুসূদন লিখেছিলেন ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য’ - ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। তত দিনে জীবনের পরিচিত ছন্দ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ ও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর পরে, ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। ‘শকুন্তলা’, ‘তারা’, ‘রুক্মিণী’, ‘কৈকেয়ী’, ‘শূর্পণখা’, ‘ভানুমতী’, ‘দ্রৌপদী’, ‘দুঃশলা’, ‘জাহ্নবী’, ‘ঊর্বশী’, ‘জনা’ - এগারো জন পৌরাণিক নারী চরিত্র ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ তাঁদের প্রেমিক অথবা স্বামীকে চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠির সুর ছিল কখনও অনুনয়ের, কোথাও বা প্রশ্ন আর অভিযোগে তীক্ষ্ণ। পুরাণের প্রচলিত ছাঁদ, চেনা গল্পকে সম্পূর্ণ দুমড়ে তাকে নতুন খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল। যে প্রবণতা ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে আছে। সংস্কৃত সাহিত্য, পুরাণ, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বা ভার্জিলের ‘দ্য ইনিড’ পড়া মুক্তমনা মাইকেল এমন এক সমাজের ছবি দেখতে চেয়েছিলেন, যেখানে নারী প্রশ্ন তুলবে, বুঝে নিতে চাইবে নিজের ‘অধিকার’। যা সে সময় ছিল ‘আকাশকুসুম চিন্তা’। তাই দেখা যায়, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ কথা দিয়ে কথা না রাখা স্বামীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন কৈকেয়ী; আবার দেখা যায় যে রুক্মিণী স্বেচ্ছায় অপহৃতা হতে চেয়ে পত্র পাঠিয়েছেন দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণের কাছে। মাইকেলের ‘বীরাঙ্গনা’রা কুণ্ঠা কাটিয়ে জগৎকে জানাতে চান নিজের ইচ্ছের কথা, নিছক সংস্কারবশে মেনে নেন না স্বামী বা প্রেমিকের প্রবঞ্চনা। কিন্তু প্রথম থেকেই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর সবচেয়ে বিতর্কিত পত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘সোমের প্রতি তারা’। প্রত্যেক নায়িকার চিঠির শুরুতেই মধুসূদন কাহিনীসূত্র দিয়েছিলেন। সেখানে বলা আছে, কোন পরিস্থিতিতে সেই নায়িকা অমুককে ওই চিঠিটি লিখেছেন। তারার চিঠির মুখবন্ধ থেকে জানতে পারা যায়, ‘দেবগুরু বৃহস্পতি’র আশ্রমে বিদ্যালাভের জন্য এসেছিলেন যুবক ‘সোমদেব’। রূপবান এই তরুণের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘বৃহস্পতির স্ত্রী তারা’। শিক্ষাশেষে ছাত্র ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে গুরুপত্নী চিঠি লেখেন সোমদেবকে। যেখানে মেলে ধরেন তাঁর অনুক্ত কামনা। মধুসূদন লিখেছিলেন - “সোমদেব যে এতাদৃশী পত্রিকাপাঠে কি করিয়াছিলেন, এ স্থলে তাহার পরিচয় দিবার কোন প্রয়োজন নাই। পুরাণজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা অবগত আছেন।” আর গোলমাল বাধে এখানেই। আসলে কী করেছিলেন সোমদেব? পুরাণে আছে, সিক্তবসনা তারাকে দেখে সোমদেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এমনই সে উত্তেজনা যে সব কিছু ভুলে তিনি অপহরণ করেন তারাকে। তারা যথাসাধ্য বাধা দেন। বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকেন কে তিনি। পতিব্রতা গুরুপত্নীকে জোরপূর্বক সঙ্গম করলে যে সহস্র ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়, সে কথাও জানাতে ভোলেন না। কিন্তু কামোন্মত্ত সোমদেব জল-স্থল-পাতালের নানা জায়গায় তারাকে নিয়ে যান, আর মেতে থাকেন উদ্দাম সঙ্গমে। অবশেষে ‘প্রজাপিতা ব্রহ্মা ও মহাদেবের মধ্যস্থতায়’ বৃহস্পতি ফিরে পান তাঁর স্ত্রীকে। তারা তখন গর্ভবতী, ক্রমে সোমদেবের ঔরসে জন্ম হয় ‘বুধের’। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের’ এই কাহিনী সম্পূর্ণ উল্টে যায় মাইকেলের লেখায়। সেখানে দেখা যায় দেবী তারাই কামনা করছেন ‘চন্দ্র’কে। তারা চন্দ্রের উদ্দেশে লিখছেন -
“তুষেছ গুরুর মন: সুদক্ষিণাদানে,
গুরুপত্নী চাহে ভিক্ষা, দেহ ভিক্ষা তারে।”

এক অদম্য শরীরী আহ্বান, যেখানে স্পষ্ট এক নারীর যৌন স্বাধিকারের কথা। কিন্তু মাইকেল ‘পুরাণের বদল’ ঘটিয়েছিলেন কেন? উত্তর খুঁজতে আর এক পৌরাণিক প্রসঙ্গের গিঁট খুলতে হয়। মহামতি ‘অঙ্গিরার পুত্র উতথ্য’ ছিলেন বৃহস্পতির বৈমাত্রেয় দাদা। ‘উতথ্যর স্ত্রী মমতা’ যখন গর্ভবতী, এক দিন বৃহস্পতি মমতার অসম্মতি সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে রমণে উদ্যত হন। মমতা বাধা দেন। এমনকি তাঁর গর্ভস্থ সন্তানটিও মায়ের জরায়ুপথ আটকানোর চেষ্টা করে। ‘সম্ভোগ’ ব্যাহত হওয়ায় ক্রুদ্ধ ‘দেবগুরু’ সেই সন্তানকে ‘অন্ধত্বের অভিশাপ’ দেন। মমতাও পাল্টা অভিশাপ দিয়ে বসেন বৃহস্পতিকে - এক দিন তাঁর স্ত্রী তারা-ও পরপুরুষের ভোগ্যা হবেন। তাই তারার নারীত্বের অবমাননা বুঝি একপ্রকার ‘অনিবার্য’ই ছিল। এক বিকৃতকাম পুরুষের লালসার ফলশ্রুতিতে অন্য এক পুরুষের কামনার শিকার হয়েছিলেন আর এক নারী। মধুসূদন এই ‘পৌরাণিক অশালীনতার প্রায়শ্চিত্ত’ করতে চেয়েছিলেন সদর্পে। পুরাণকথার অভিমুখটাই তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। মূল পুরাণে উল্লেখিত সোমদেবের লাম্পট্যের গল্পের পরিবর্তে সেখানে চালিকার আসনে বসিয়েছিলেন তারাকে।

মাইকেল ছন্দ ভাঙলেও সেই সময় সমাজ তো ছন্দ ভাঙতে শেখেনি। পুরাণের গল্প পাল্টে গিয়েছিল - নারী তাঁর  অধিকার নিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করছে, সেক্ষেত্রে সমালোচনার ঝড় ওঠার কথা। কিন্তু এই কাব্য তার বিষয় আর আঙ্গিকের অভিনবত্বে সেই সময় এতই আলোড়ন ফেলেছিল যে, বীরাঙ্গনাদের চিঠির উত্তর লেখার একটা প্রবণতা চোখে পড়ে পরের পঞ্চাশ বছর জুড়ে। ওই কাব্য প্রকাশকালের বছর দশেক পরেই অসমের বরাক উপত্যকার ‘রামকুমার নন্দী মজুমদার’ লিখেফেলেছিলেন ‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য’। যেখানে ‘চন্দ্র’ বলছেন -
“কলঙ্কী শশাঙ্ক কেহ বলে নাই সতি!
এত দিন, কিন্তু তব ভবিষ্যত-কথা
দৈববাণী সম এবে ফলিবে দাসেরে;
ধরিবে কলঙ্ক এ কিঙ্কর তব নামে -
শোভিবে সোমের অঙ্কে সে কলঙ্করেখা,
ভৃগুপদচিহ্ন যথা মাধবের হৃদে।
তারানাথ নাম মম তেয়াগিয়া আজি,
হইব তারার দাস জনমের মত!”

ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় উত্তরসূরিরা কিভাবে মধুসূদনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তারই আভাস পাওয়া যায় ওই ‘উত্তর-বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য’ পড়লে।
তবে নিজের কাব্যে অলংকার ও উপমা প্রয়োগে মধুসূদন প্রথাজীর্ণ ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পারেন নি। তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত বহু অলংকারই ভারতকাব্যের চিরন্তন সঞ্চয় থেকে গৃহীত, পুরাণ-চেতনার দ্বারা অনুবিদ্ধ। কোথাও কোথাও তাঁর মৌলিকতা আশ্চর্যভাবে প্রকাশ পেলেও মোটের উপরে তিনি পাঠক-পাঠিকার চিরাভ্যস্ত প্রত্যাশাকে নিদারণভাবে ক্ষুন্ন করেন নি, দেবলোক ও স্বর্গ-নরকের পরিকল্পনাতে তিনি পাশ্চাত্য চিন্তা প্রভাবিত হলেও, যথাসম্ভব পৌরাণিক আদর্শের প্রতি বিশ্বস্তই থেকেছেন, উৎকটভাবে প্রচলিত সংস্কারের উল্লম্বন করেন নি। সচেতন সৃষ্টি প্রয়াসে তিনি বিদেশের মুখাপেক্ষী হলেও অবচেতনের গভীরে তিনি জাতীয় সংস্কৃতির টানে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর সরস্বতীর স্তব, বাল্মীকি বন্দনা ও এই ভক্তিবিহ্বলতা প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গী সবই সংপ্রাচীন ভারতীয় কাব্যসাধনার শিষ্টরীতির অনুগামী। এই অস্থিমজ্জাগত ভাবচেতনার মুলে তাঁর মনোভূমিতে কোথায় প্রচ্ছন্ন ছিল, তাঁর জীবন কাহিনী সে সম্বন্ধে নীরব। এর হেতু খুঁজতে গিয়ে অন্য পর্যাপ্ত কারণের অভাবে সেটাকে মধুসূদনের জাতিস্মরতার অলৌকিক নিদর্শন রূপে নেওয়া সম্ভব নয়। যিনি নিজের সমস্ত জীবন দিয়ে পাশ্চাত্য আদর্শের সাধনা করেছিলেন, শেষপর্যন্ত দেখা গিয়েছিল যে, দেশের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক চেতনার মূল পর্যন্ত প্রসারিত ও অবিস্মরণীয়। মধুসূদনের জীবন ও কাব্যের অসমাহিত দুটি সমস্যা দুটির হল - (১) তাঁর কবি-জীবনের ভূমিকা সম্বন্ধীয়, ও (২) তাঁর মনে প্রাচ্যভাবের বদ্ধমূলতা বিষয়ক। কেমন করে তিনি মহাকবি হলেন ও কেমন করে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয়কারী জীবনচেতনার প্রতীক রূপে তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন - এই দুই প্রশ্নের সমাধান শেষ পর্যন্ত প্রতিভারহস্যের স্বরূপ-উপলদ্ধির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। আধুনিক যুগের অন্য দুই প্রতিভাধর প্রবর্তক - বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সাহিত্য সমালোচকদের সেই সংশয়িত মনোভাব নেই। কেবল এই ভাবগঙ্গার আদি ভগীরথ এককালে মাইকেল, এখন শ্রীমধুসূদন সম্বন্ধে এখন মানুষ যত বেশি জানেন, তার চেয়ে অনেক বেশী জানেন না - এই ধারণাই অখণ্ডিত থেকে গিয়েছে।

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image