• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৫ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

চট্টগ্রাম রেলওয়ের চার কোটির সম্পদ হাওয়া


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২৯ আগষ্ট, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১:২৩ এএম
এক বছরে ৪ কোটি টাকার সম্পদ হাওয়া
চট্টগ্রামে রেলওয়ে চুরির ঘটনা দায়সারা তদন্ত

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগে গত এক বছরে প্রায় চার কোটি টাকার সম্পদ চুরি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলা ও তদন্ত কমিটি হয়েছে। দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে কর্তৃপক্ষ পার পেলেও উদ্ধার হয়নি রেলের কোনো চুরি যাওয়া জিনিস ও টাকা। মূলত চুরির ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের সাজা না হওয়ায় বার বার রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
রেলে চুরি যাওয়ার জিনিসের মধ্যে রয়েছে ইঞ্জিনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ, স্লিপার, তামার পাতসহ মূল্যবান মালামাল। এছাড়া ভুয়া বিলে প্রায় কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে।

অভিযোগ রয়েছে, চুরির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক সময় রাস্তার ভবঘুরে ও টোকাইদের আসামি করে দায়সারা রিপোর্টও দেওয়া হয়। ফলে আসল অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।

২ কোটির মাল চুরির আসামি ‘ভবঘুরে’
২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশন এলাকা থেকে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর টুল ভ্যানের প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে। রেলের এক কর্মচারী ট্রেনের কোচ মেরামতের জন্য মালামাল আনতে গেলে চুরির বিষয়টি নজরে আসে।
অথচ টুল ভ্যানটি রেলওয়ে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর ইনচার্জ ট্রেন এক্সামিনার (হেড টিএক্সআর) এবং ওই বিভাগের স্টোর মুন্সির দায়িত্বে থাকে। টুল ভ্যানটি প্রতিদিন সকাল ৯টায় ও বিকেল ৫টায় দুইবার পরীক্ষণ করার নিয়ম রয়েছে হেড টিএক্সআর ও স্টোর মুন্সির। এছাড়া রেলওয়ে সম্পদের পাহারায় থাকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) তাদের বিরুদ্ধেও আছে অভিযোগের পাহাড়।

চুরির ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে রহস্যজনকভাবে রেলওয়ে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন ডিপোর ইনচার্জ ট্রেন এক্সামিনার, মুন্সি বা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।

এরপর লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশের পাইকপাড়া গ্রামের আফসারুল ইসলাম (২২), একই গ্রামের সাগর (২৩) নামের দুই ভবঘুরে এবং উপজেলার পাশাপুর গ্রামের ভাঙারি ব্যবসায়ী নূরে আলমকে (৩০) ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

আত্মসাৎ ৯৭ লাখ, হয়নি ফৌজদারি মামলা:
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের হিসেব বিভাগ ও সীমান্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা মিলে এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘দি কসমোপলিটন করপোরেশন’র কর্মচারী পরিচয়ে ৯৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এতে রেলের সাত কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ মিললেও মামলা হয় মাত্র একজনের বিরুদ্ধে। আবার এ ঘটনায় ফৌজদারি মামলা না দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়।
এ ঘটনায় রেল কর্মচারীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিন আসামি হলেন—রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান অর্থ উপদেষ্টা ও হিসাব কর্মকর্তা রফিকুল বারী খানের দপ্তরের অস্থায়ী কম্পিউটার অপারেটর হাবিব উল্লাহ খান হাবিব, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স দি কসমোপলিটন কর্পোরেশনের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেওয়া মো. সোহাগ (৩৫) ও সীমান্ত ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখার হিসাবরক্ষক কোহিনুর আকতার (৩০)।

অভিযোগ উঠেছে, রেলওয়ের সাত কর্মকর্তার হাত দিয়ে বিলগুলো পাস এবং চেক বিতরণ হলেও তাদের বিরুদ্ধে শুধু ‘কর্তব্যে অবহেলা’র অভিযোগ আনা হয়। তাদের বাঁচাতে ফৌজদারি মামলার পরিবর্তে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করেছে রেলওয়ের তদন্ত কমিটি।

মাল চুরি ২৫ লাখ টাকার, অভিযোগে ২৫ হাজার:
চলতি বছরের ৩ জুন রাতে রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির (আরটিএ) মডেল রুমে চুরির ঘটনা ঘটে। মডেল রুমে থাকা পিতলের রেললাইন, ট্র্যাক সার্কিটে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক তার (সুপার অ্যানামেল কপার ওয়্যার), পয়েন্ট মেশিনের রডসহ বিভিন্ন দামি সরঞ্জাম নিয়ে যায় চোরের দল।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চুরি হওয়া মালামালের দাম অন্তত ২০-২৫ লাখ টাকা। কিন্তু চুরির তিনদিন পর এসব মালামালের মূল্য ২৫ হাজার টাকা দেখিয়ে অভিযোগ দেওয়া হয় নগরীর বন্দর থানায়।
এর আগে চুরির ঘটনার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়নি। ওই সময় রেক্টর ছুটিতে থাকায় তাকে ফোনে জানানো হলে তিনি মামলার পরামর্শ দেন। তবে মডেল রুমটি দেখভালের দায়িত্ব ছিল সংকেত ও টেলিকমিউনিকেশন প্রকৌশল বিভাগের হাতে। আর রাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল আরএনবি। কে মামলা করবে—তা চিন্তা করতে করতেই তিন দিন পার হয়ে যায়।

এক মাসে তিনটি চুরির ঘটনা
চলতি বছরের ২৩ মে পাহাড়তলী লোকোশেড থেকে ভুয়া ভাউচারে ট্রাকভর্তি স্লিপার ও রাবার চুরি করে বিক্রি করতে গেলে পুলিশের হাতে চালক ও হেলপার ধরা পড়ে সাগরিকা মোড়ে। ওই ঘটনার পর কোনো তদন্ত হয়নি। এর কিছুদিন পর ইঞ্জিনের ৬টি ব্রাশ বার (দামি তামার তার) চুরি হয়। এছাড়া লোহা ও যন্ত্রাংশ মিলে ৩ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয় মে মাসেই। অথচ এক মাসে কয়েকটি চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটি করলেও কেউ শাস্তির সম্মুখীন হয়নি বলে জানা গেছে। মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও ইঞ্জিনের নিরাপত্তায় রয়েছে মাত্র তিনজন আরএনবি সদস্য। এর মধ্যে অনেকেই ডিউটি ফাঁকি দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়তলী লোকেশেড ইনচার্জ আবু জাফর বলেন, ‘লোকোশেডের চুরির প্রধান কারণ হলো নিরাপত্তার অভাব। মাত্র তিনজন আরএনবি সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। রেলের সম্পদ পাহারাদার দায়িত্ব আরএনবির। চুরির বিষয়ে আমরা মামলা করি। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া হয়।’
সিজিপিওয়াই যেন ‘চোরের আখড়া’

চলতি বছরের জুনে বন্দরের সিজিপিওয়াইতে (গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) নতুন গাড়ি পরিবহনের জন্য আনা প্রায় ৫ লাখ টাকার লোহা চুরির ঘটনা ঘটে। ডিসেম্বরের শুরুতেও ২০০০ সিরিজের একটি ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরির ঘটনা ঘটে এ ইয়ার্ডে। যেটির আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ে আছে।

এছাড়া ২০২৩ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা তিনটি ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরি হয় সিজিপিওয়াই থেকে। কবে চুরি হয়েছে সেটি রেলওয়ে জানতে না পারলেও ৯ জুলাই বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ঘটনায় আরএনবির পক্ষ থেকে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করে।

সরকার ও এডিবির যৌথ অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন (রোলিং স্টক সংগ্রহ)’ প্রকল্পের আওতায় ৪০টি ব্রডগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয় করেছে রেলওয়ে। ইতোমধ্যে ৩০টি লোকোমোটিভ দেশে চলে আসে।
সিজিপিওয়াইয়ের এসএসএই (ইনচার্জ) মো. আবদুল মালেক বলেন, ‘ইঞ্জিনের ক্যাবল চুরির পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্তে কি উঠে এসেছিল, তা আমার মনে নেই।’

ট্রেন থামিয়ে চলে তেল চুরি:
চট্টগ্রামে তেলবাহী ওয়াগন ও ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে প্রতিদিনই চুরি হয় তেল। সিজিপিওয়াই থেকে তেলবাহী ওয়াগন বের হলে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার পথেই চুরি করা হয় তেল। একইসঙ্গে পণ্যবাহী ট্রেন থেকে তেল চুরি করা হয় ফেনীর শর্শদী স্টেশনে থামিয়ে।

এছাড়া চট্টগ্রামের টাইগারপাসের মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে রেলের বগি (কোচ) পরিষ্কার শেষে রেল স্টেশনে আনার পথেও ঘটে তেল চুরি। ২০২৩ সালের ১৪ মার্চ দুপুরে মার্শালিং ইয়ার্ড থেকে মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি পরিষ্কার শেষে স্টেশন আনার পর ৩০ লিটারের এক গ্যালন মবিল ধরা খায় আরএনবির হাতে। পরে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তখন বগিটি ইয়ার্ড থেকে আনার পথে কদমতলী এলাকার ফ্লাইওভারের নিচে (কোচ নম্বর ৬৩০৭) এই রকম আরও ছয় গ্যালন মবিল নামিয়ে নেয় বলে জানা গেছে।
এছাড়া ফেনীর শর্শদী স্টেশনে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার লিটার তেল চুরি হয়। ট্রেনটি এ স্টেশনে প্রায় ২০ মিনিট বিরতি দেয়। চুরি হওয়া এসব তেলের বাজার মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা, মাসে যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৪ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে সিজিপিওয়াইয়ের এসএসএই (ইনচার্জ) মো. আবদুল মালেক বলেন, ‘সিজিপিওয়াইয়ের রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিভিন্ন জেলায় পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে ট্রেন ফেনীর শর্শদী স্টেশনে এক সময় তেল চুরির ঘটনা শুনেছি। তবে এখন মনে হয় চুরি হয় না, হলেও এটি আমার জানা নেই। চুরির বিষয় আমরা বিভিন্ন সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে থাকি। চুরি বন্ধে ব্যবস্থা ওনাদের হাতেই।’
লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের আরএনবির চিফ ইন্সপেক্টর মো. সালামত উল্লাহ বলেন, ‘এ রকম কোনো তেল চুরির বিষয়ে আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
পাহাড়তলী ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন শপে: 

ওয়ার্কশপে চুরি হচ্ছে অহরহ, উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নজরে এলেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সূত্রে জানা যায় এই সব চুরিতে জড়িয়ে আছে আরএনবি। অভিযোগ পাওয়া যায় আরএনবি চোর ধরেও ছেড়ে দিচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। সম্প্রতি ট্রেন লাইটিং সহ ইলেকট্রিক অফিসে বড় বড় কয়েকটি চুরির ঘটনা ঘটে। তাদের নজরে এলেও ধামাচাপা চেষ্টায় মেতে উঠেন। জানা যায় এইসব চুরিতে ইলেকট্রিক অফিসে একজন ইনচার্জ সহ কর্মচারীরা জড়িত।

পাহাড়তলী ডজিলে শপ:  ডিজেল শপে এর মধ্যে অনেক গুলি চুরির ঘটনা ঘটে এই চুরির ঘটনায় আরএনবির সিপাহী সি/৮৮৩-ই মোঃ জসিম উদ্দিন জড়িত বলে সূত্রে জানা যায়। তাকে এই শপ থেকে কয়েক বার অন্যত্র বদলি করা হলে ও উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ম্যানেজ করে পুনরায় ফিরে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় অফিস টাইমে অফিস করেন না সারা দিন টিকেট কালোবাজারি তে মেতে উঠেন। সূত্রে জানা যায় নামে বেনামে অটল সম্পদের মালিক বরিশাল বাড়ীতে ৫ তলা বাড়ী করছেন কিনেছেন বিভিন্ন ধানি জমি স্ত্রী নামে আছে ব্যাংকে প্রচুর টাকা। শপে আছে চোরের বড় সিন্ডিকেট, আর এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করেন তিনি। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আকতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘নিরাপদ ও সাশ্রয় হিসেবে জনপ্রিয় হলেও দুর্নীতির কারণে রেলখাত পিছিয়ে যাচ্ছে। হাতগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত। জবাবদিহিতা না থাকায় চুরি বন্ধ হচ্ছে না।’

রেলওয়ের বিভাগীয় কর্মব্যবস্থাপক (পূর্ব) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো দুর্নীতি ও চুরির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে দোষীদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
 

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image