• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য যে শর্তটা জরুরি


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৩:৪৭ পিএম
স্মার্ট,বাংলাদেশ
স্মার্ট বাংলাদেশ, মেট্রোরেল

রেজানুর রহমান

আমরা অনেকেই কোনো ছেলে অথবা মেয়েকে দেখে অজান্তেই বলে ফেলি, বাহ দেখতে স্মার্ট তো। কেন বলি? তাকে দেখতে ভালো লাগে। তার মানে সে দেখতে সুন্দর অথবা সুন্দরী বলেই কী দেখতে ভালো লাগে? সুন্দরের প্রতি মানুষের একটা সহজাত আকর্ষণ থাকে। ফর্সা মানেই সুন্দর। একটা ফর্সা মেয়ে আর কালো মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়ালে প্রথম দর্শনে ফর্সার প্রতিই সবার আকর্ষণ বাড়বে। পুরুষের বেলায়ও তাই। তবে কালো আর ফর্সার মধ্যেই মানুষের চরিত্রগত গুণাগুণ নির্ভর করে না।

চরিত্রগত গুণাগুণ নির্ভর করে তার মেধা ও মননের ওপর। অনেক ফর্সা একটি মেয়ে, দেখতে পরির মতো। অথচ তার কোনো গুণ নেই। কর্কশ সুরে, অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। ব্যবহার ভালো না। তাকে সুন্দরী বলা সাজে না। অন্যদিকে গায়ের রঙ কালো, কিন্তু চরিত্রগত গুণাগুণ এক কথায় অসাধারণ। মানুষের প্রতি তার অনেক মায়া। হাসিতে যেন মুক্ত ঝরে। অনেক মেধাবী। তথ্য প্রযুক্তিগত ভাবনায় সে বেশ অগ্রসর। পজিটিভ পরিবর্তনকে সে সব সময় স্বাগত জানায়। তাকেই আমরা প্রকৃত স্মার্ট বলতে পারি। অর্থাৎ চেহারার সৌন্দর্যই  স্মার্টনেসের প্রকৃত শর্ত নয়। প্রকৃত শর্ত হল মেধা ও মনন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এটাই সময়ের দাবি। তিনি যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তখন কেউ কেউ ঈর্ষাকাতর ভঙ্গিতে নানা মন্তব্য করেছিলেন। ভাবটা এমন ডিজিটাল বাংলাদেশ আবার কী জিনিস? এখন তারাই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন।

প্রাত্যহিক জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলি। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের বিল ঘরে বসেই দেয়া যাবে কেউ কি ভেবেছিল? গ্যাস,পানি ও বিদ্যুতের বিল দেয়ার জন্য কয়েক বছর আগেও ব্যাংকে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হতো। আর এখন ঘরে বসেই এই বিলগুলো দেয়া যায়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সে এক দারুণ ঝক্কি ঝামেলার বিষয় ছিল। আবেদনপত্র কেনার জন্য প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হতো। আবার আবেদনপত্র জমা দেয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে হতো। একই কাজে তৃতীয়বার আসতে হতো ভর্তি পরীক্ষায় বসার জন্য। আর এখন ঘরে বসেই অনলাইনে ভর্তি ফরম সংগ্রহ, ভর্তি ফরম জমা দেয়া যায়। পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য অতীতকালে নির্ধারিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে যেতে হতো। এখন ঘরে বসেই ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল জানা সম্ভব।

শুধু কি ভর্তি পরীক্ষা? বাজার সদাই করবেন, বাজারে না গেলেও চলবে। অনলাইনে অর্ডার করলেই বাসার দরজায় চলে আসবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। মাছ, মাংস, ডিম, তেল, চাল, ডাল, লবণ, শাকসবজি, ক্রোকারিজ-ঘরে বসে কি চান আপনি? শুধু অনলাইনে নির্ধারিত ডিজিটাল মার্কেটে অর্ডার করুণ। আলাউদ্দিনের দৈত্য নির্ধারিত পণ্য হাজির করবে আপনার ঠিকানায়। উড়োজাহাজে কোথাও যাবেন। এখন যেতে হয় না নির্ধারিত স্থানে টিকিট কেনার জন্য। অনলাইনে এই সুবিধাও অবধারিত। জন্মদিনে প্রিয়জনকে উপহার পাঠাবেন সেটাও অনলাইনে পাঠানো সম্ভব। অনলাইনে আরও অনেক সুবিধা গ্রহণ করছি আমরা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানের অনুপ্রেরণায় মূলত আজকের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এবার শুরু স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম।

গত বছরের শেষ দিকেই স্মার্ট বাংলাদেশের একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। মেট্রোরেল দেশের প্রচলিত রেল ব্যবস্থার সঙ্গী নয়। দেশে প্রচলিত রেলগাড়ি মানেই সহজেই ছাদে ওঠা যায়। দরজায় বাদুড় ঝোলা হয়ে যাওয়া যায়। টিকিট না কিনেও ভ্রমণ করা যায়। যখন খুশি তখন চেইন টেনে থামানো যায়। মেট্রোরেল ব্যবস্থা একেবারেই বিপরীত। এই ট্রেনে চড়তে গেলেই প্রথম শর্ত, আগে টিকিট কিনুন। যাকে বলা হচ্ছে ভ্রমণ কার্ড। এজন্য আপনাকে সুনির্দিষ্ট আইন মানতেই হবে। আপনি এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি তাই বলে দাপট দেখিয়ে দলবল সাথে নিয়ে বিনা টিকিটে মেট্রোরেলে চড়ার কোনো সুযোগ নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং কার্ড কিনে মেট্রোরেলে চড়েছেন এবং স্মার্ট বাংলাদেশের একটি দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন সবার সামনে। বলতে গেলে মেট্রোরেল বদলে দিয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিদ্যমান নিয়ম কানুন। মেট্রোরেল ব্যবহার করতে গেলে যাত্রীকে স্মার্ট হতেই হবে। বাধ্য হয়ে যাত্রীরা সেই চেষ্টাও করছেন।

অর্থাৎ পুরনো ধ্যান ধারণা বদলাতে হবে। সেজন্য অবশ্য পরিবেশ তৈরি করাও জরুরি। আগাম টিকিট না কিনে অর্থাৎ আগাম কার্ড সংগ্রহ না করে মেট্রোরেলে চড়া যাবে না-এটাই নিয়ম। ফলে মেট্রোরেলের যাত্রীরা সেভাবেই নিজেদের তৈরি করছেন। বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপারের জন্য নির্ধারিত টোল দিতে হবে-এটাই নিয়ম। সানন্দে এই নিয়ম পালন করছেন দেশের মানুষ। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও একই চিত্র। হুড়োহুড়ি নেই। নিয়ম মেনেই চলছে সেতু পারাপার। অথচ যখন পদ্মায় সেতু ছিল না তখন যে যার মতো নিয়ম তৈরি করে পারাপার হয়েছে। নিয়ম যে একেবারেই ছিল না তা কিন্তু নয়। কিন্তু নিয়ম মানার ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। নিয়ম মানলে মানো, না মানলে নাই। কেউ তোমার কিছুই করতে পারবে না। পরিস্থিতি এ রকম হলে আদৌ নিয়ম মানতে চায় না অনেকে। কিন্তু স্মার্ট যারা তারা কোনো কাজ করতে গেলে প্রথমে নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানতে চান। নিয়মের বাইরে যেতে চান না।

প্রায় ২৫-৩০ বছর আগের কথা। আমার এক জাপানি মেয়ে বন্ধু ঢাকায় বেড়াতে এসেছিল। ছিল আমার বাসায়। ও যখন জাপানে ফেরত যাবে ডলার কেনার প্রয়োজনে মতিঝিল এলাকায় তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাংলা বোঝে না। ডলার বিক্রেতার সাথে কথা হলো। এক পর্যায়ে ডলার বিক্রেতাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে ডলারের রেট কমানো যায় কি না এই অনুরোধ করলাম। এই ঘটনায় আমার জাপানি বন্ধু বোধকরি একটু নাখোশ হয়েছিল। তাকে দূরে রেখে ডলার বিক্রেতার সাথে নিচু স্বরে কথা বলাকে সে ভালো চোখে দেখেনি। তার একটাই বক্তব্য কানে কানে নিচে স্বরে কথা হবে কেন? কথা হবে প্রকাশ্যে। এটাই স্মার্টনেস।

আমাদের দেশে এখনও সেই পরিবেশ তৈরি করা যায়নি। একদাম এক রেটের দোকান আছে অনেক। এক ছাদের নিচে অনেক পণ্য কেনা-বেচার সুযোগ। কিন্তু নীতি-নৈতিকতা মানতে নারাজ অনেকেই। এমন একটা দোকানের কথা বলি। দোকানে দেখা গেল বিভিন্ন দ্রব্যের দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ শতকরা ১০%, ১৫% এমনকি ২০%, ২৫% ভাগ কমিশনের লোভনীয় অফার চলছে। কিন্তু সবই শুভঙ্করের ফাঁকি। কমিশনের ক্ষেত্রে মূল দামটা এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে যাতে করে দ্রব্যটি অর্থাৎ জিনিসটি নির্ধারিত কমিশনে বিক্রি করলেও মালিকের আগের মতোই লাভ থাকবে। যদিও এটা স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষণ নয়।

দেশের চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে স্মার্ট বাংলাদেশ স্লোগানকেই গুরুত্ব দিতে হবে। স্মার্ট মানে মেধাবী মানুষ। যার মধ্যে শততা ও নীতিহীনতা প্রকট। সে সত্যবাদী। সেই স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করে আজকের লেখাটি শেষ করতে চাই। ১৯৯৬ সালের দিকে জাপান সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩টি দেশের প্রায় ৩০০ জন তরুণ-তরুণী নিপ্পন মারু নামে অত্যাধুনিক একটি জাহাজে চড়ে ৭টি দেশ সফর করেছিলাম। ফুটবল, ক্রিকেট খেলার মাঠ ছাড়া আর সব কিছুই ছিল ওই জাহাজে। অত্যাধুনিক মার্কেট, একাধিক সিনেমা হল, বিনোদনের আরও নানা ক্ষেত্র ছিল অবারিত। জাহাজের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিদিন একটি দৈনিক পত্রিকাও প্রকাশ হতো। জাপানের টোকিও থেকে প্রথম যেদিন ১৩টি দেশের ৩০০ জন ছেলে-মেয়ে জাহাজের বিভিন্ন রুমে ওঠে তখন তাদের অনেক কিছু খোয়া যায়। যেমন হাতঘরি, চশমা, মানিব্যাগ, দামি পোশাক, দামি চাদর, জুতা, ব্রেসলেট আরও অনেক কিছু। প্রথম দিন ডাইনিং হলের সামনে একটি বিরাট টেবিলের ওপর বিভিন্ন জনের হারিয়ে যাওয়া জিনিস পত্রের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

শিরোনাম দেয়া হয় ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’। প্রথম দিনে টেবিলের ১০০ ভাগের ২০ ভাগও খালি হলো না। অথচ ইচ্ছে করলে যে কেউ যে কোনো জিনিস নিজের মনে করে নিলে নিতে পারত। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪ জন তরুণ-তরুণী ওই প্রোগ্রামের সদস্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। লম্বা টেবিলের ওপর অনেক দামি জিনিসপত্র পড়ে আছে। দুই একজন যে নিজের মনে করে অন্যের দামি জিনিস নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেনি তা কিন্তু নয়। তবে পরিবেশের কারণে নীতিহীন কাজটি করার সুযোগ কেউই নিতে চায়নি।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে পরিবেশের ওপর প্রথম জোর দিতে হবে। যেমন মেট্রোরেল একটি উদাহরণ। মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে হলে নিয়ম মানতেই হবে। এজন্য কর্তৃপক্ষ একটা পরিবেশ তৈরি করেছেন। অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও নিয়ম মানার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। যাতে করে সবাই নিয়ম মানতে বাধ্য হয়। নতুন বছরে শুভ কামনা সবার জন্য।

কথাসাহিত্যিক,নাট্যকার এবং সম্পাদক, আনন্দআলো

 

ঢাকানিউজ২৪.কম / এম আর

আরো পড়ুন

banner image
banner image