
মোনায়েম সরকার
সারাবিশ্বে এখন যে অশান্তির বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে তার জন্য মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নীতি-আদর্শ নেই, তাদের নীতি একটাই কিভাবে টাকা ও সম্পদ লুণ্ঠন করা যায়। এই টাকা, সম্পদ লুণ্ঠন করতে গিয়ে তারা দেশে দেশে যুদ্ধ বাধাচ্ছে, অন্যায়ভাবে লক্ষ লক্ষ নিরীহ লোক হত্যা করছে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে গিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থি’তি এখন এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে, আমেরিকার ক‚টকৌশলের কারণে যেকোনো সময় পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে।
সারা পৃথিবীর মানুষ এখন আমেরিকার ক্ষমতার কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমেরিকাকে শক্তিহীন করতে হবে। ধনে-সম্পদে-অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত আমেরিকাকে শক্তিহীন করতে না পারলে কখনোই পৃথিবীতে শান্তি আসবে না।
‘শক্তি’ চলমান স্রোতের মতো। এক জায়গায় শক্তি কখনো স্থির থাকে না। পৃথিবীতে অতীতে অনেক দেশই শক্তিমান হয়েছিল, আবার তাদের পতনও প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীর মানুষ। এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এতটাই বিশাল ছিল যে, সেসময় বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হয় না। কথাটি ঐতিহাসিকভাবে সে সময় ঠিক থাকলেও আজকের প্রেক্ষাপটে রূপকথার গল্পের মতোই শোনায়। যেই ব্রিটিশ সরকার এক সময় এত প্রতাপশালী ছিল, আজ তাদের শান্ত ভদ্র মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর দেশে দেশে এই সাদাচামড়ার সুন্দর মুখের মানুষগুলো কি পরিমাণ অত্যাচার আর নির্যাতন করেছে।
আমেরিকা এমন একটি দেশ যার নিজের দেশেই ঠিকমতো গণতন্ত্র নেই। অথচ সারাবিশ্বে সে গণতন্ত্র ফেরি করে বেড়ায়। তার দেশেও নির্বাচনে কারচুপি হয়, নির্বাচনে জনগণের রায়কে অস্বীকার করে সেখানে জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পার্লামেন্ট ভবনে আক্রমণ করে, ভাংচুর ও শান্তিপ্রিয় লোকজন হতাহত করা হয়। যাদের দেশে নিজেরাই জনগণের ভোটের রায় মেনে নেয় না, তারা যখন অন্যদেশের সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তির্যক মন্তব্য করে, তখন সেটা খুবই হাস্যকর শোনায়। কিš‘ তারা যেহেতু নিজেদের পৃথিবীর ‘মোড়ল’ বলে দাবি করে এবং যে কারণেই হোক পৃথিবী তা মেনে নিয়েছে। তাই যেকোনো দেশের যেকোনো বিষয়ে কথা বলা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলা বন্ধ করা উচিত আমেরিকার। পৃথিবী এখন আর আগের জায়গায় নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে প্রতিদিনই পৃথিবী পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তন অনেক দেশকেই এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি। এর ফলে আমেরিকার মতোই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বিশ্বের আরও অনেক দেশ। তারা কিছুতেই নীতিহীন আমেরিকার কথায় উঠ-বস করতে চাইছে না। সে কারণেই আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতা ও সম্পদলোভী আমেরিকা। তবে মনে হচ্ছে সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্ররা যদি কঠিনভাবে একবার আমেরিকাকে গলা চেপে ধরে, তাহলে তার বাঁচা কঠিন হয়ে পড়বে।
আমেরিকা মানবতার কথা বললেও তারা মোটেই মানবিক নয়। তাদের দেশে স্কুলে বন্দুকধারী দুর্বৃত্তরা ঢুকে যেভাবে নির্বিচারে শিশু-কিশোরদের হত্যা করে তা অন্য কোথাও সচরাচর দেখা যায় না। একটি সভ্য দেশে এ রকম নির্বিচার হত্যাকান্ড কেউ মেনে নিতে পারে না। অথচ এই বর্বরতাই সেখানে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখা যা”েছ। বর্ণবাদী আচরণে বিশ্বের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে আমেরিকা। সাদা-কালো মানুষের ভেদাভেদ সেখানে নগ্নরূপ ধারণ করেছে। দিনে-দুপুরে সেখানে কালো মানুষদের হত্যা করছে সাদা মানুষেরা।
রাষ্ট্রীয় মদদে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে হত্যা করছে কালোদের। বর্ণবাদী আচরণ প্রদর্শন করে যারা মানবতার মুখে চুলকালি লেপন করে, তাদের মুখে মানবিকতার উপদেশ শুনলে কার না হাসি পায়। আমেরিকা বুঝতে পারছে না, তাদের পাগলামি দেখে বিশ্ববাসী হাসছে। এই হাসি যখন বিরক্তিতে রূপ নিবে, তখনই সারাবিশ্বে শুরু হবে আমেরিকাবিরোধী লড়াই। যার পূর্বাভাস এখন কিছুটা পাওয়া যা”েছ।
আমেরিকা একটি ইতিহাস-ঐতিহ্যহীন জাতি। এ জাতির প্রকৃতপক্ষেই কোনো ইতিহাস নেই, যাদের ইতিহাস এখনও তিনশ’ বছর অতিক্রম করেনি, অথচ তারা তিন হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সভ্যতাকেও বোমার আঘাতে অবলীলায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। আরব বসন্তের নামে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আমেরিকা ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করেছে। মিশর, সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানসহ অসংখ্যক দেশ মার্কিন আগ্রাসনের কারণে মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে।
এসব সমৃদ্ধ দেশের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমান রূপের এতটাই পার্থক্য চোখে পড়ে যে, নতুন প্রজন্মের মানুষদের বোঝানোই যাবে না, মার্কিন আগ্রাসনের পূর্বে এসব দেশ সম্পদে ও সম্মানে কত মর্যাদাবান ছিল। সুন্দরকে অসুন্দর বানানো, শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই আমেরিকা এগিয়ে যাচ্ছে এটা এখন পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পেরেছে বলেই আমেরিকার বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
দেশে দেশে শান্তিপ্রিয় মানুষ আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সত্যি সত্যিই যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবী বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায় সেদিন আমেরিকার অহংকার চ‚র্ণ হতে বাধ্য। আমেরিকার অহংকারী বুকে পদাঘাত করার সময় এসেছে। বানরের হাত থেকে অগ্নিমশাল কেড়ে না নিলে অরণ্য যেভাবে দাবানলে পুড়ে, আমেরিকার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে না নিলে সেভাবেই আগুনে পুড়ে ছারখার হবে সমগ্র বিশ্ব।
আমেরিকা একটি মিথ্যাবাদী দেশ। এদেশের কর্তাব্যক্তিরা অবলীলায় মিথ্যা কথার কাব্য রচনা করে বিশ্ববাসীর মগজ ধোলাই করতে সর্বদা ব্যস্ত। ৯/১১-এর সময়ে তারা যে কি পরিমাণ মিথ্যাচার করেছে পৃথিবীর মানুষ তা ভুলে যায়নি। ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে কল্পিতকাহিনী তৈরি করে, মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্রের জিকির তুলে যেভাবে সেই দেশটিকে ধ্বংস করা হলো সেই ইতিহাস কোনোদিনই পৃথিবীর মানুষ ভুলবে না। আজ যদিও প্রমাণ হয়েছে সাদ্দাম হোসেনের হাতে কোনো বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ছিল না, কিন্তু এ কথায় আর কোনো লাভ নেই। ইরাকের সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে গাদ্দাফির দেশ লিবিয়াতেও।
আমেরিকাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত করতে না পারলে, শান্তি শুধু দূর থেকেই মানুষকে হাতছানি দেবেÑ কাছে আসবে না। মানুষের পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য করতে হলে অমানুষের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে। দানবীয় শক্তির পতন হয়ে মানবিক শক্তির উদ্বোধন ঘটলেই পৃথিবী সুন্দর ও শান্তিময় হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: