• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

আমাদের বাতিঘর রণেশ মৈত্র


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৯:২৪ এএম
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আজীবন লিখেছেন মুক্তির গান
রণেশ মৈত্র

নরেশ মধু

২৫ সেপ্টেম্বর রোববার। রাতের অন্ধকার ভেদ করে সাঁই সাঁই বেগে চলছে সিলেটমুখী শাহজাদপুর ট্রাভেলস। প্রচণ্ড ক্লান্ত। গাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়; বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রীদের জন্য। তবুও জীবনের তাগিদে ছুটে চলা। ভোর সাড়ে ৫টায় সিলেট কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছি। দু'চোখ ভরা নিদ্রাহীন চোখে ক্লান্তির ছাপ; শরীরজুড়ে বইছে অস্থিরতা। একটু আলোর অপেক্ষায় সেখানেই। পুব আকাশে আলোর উঁকি-ঝুঁকি। প্রশান্তির বাতাস বইছে।

উপশহরের গেস্ট হাউসে পৌঁছে শরীরটাকে ছেড়ে দিই বিছানায়। মোবাইল ফোনে ফেসবুক খুলতেই সকালের প্রশান্তির বাতাস আর প্রশান্তিতে রইল না। ঈশ্বরদীর সাংবাদিক খন্দকার মাহবুবুল হক তাঁর ফেসবুকে এক বাতিঘরের হঠাৎ আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার সংবাদ দিলেন। চলে গেলেন পাবনার কিংবদন্তি একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসংগ্রামী, সাংবাদিক, রাজনীতিক রণেশ মৈত্র। অসীম আকাশের মতো শূন্যতা থেকে যাবে অনন্তকাল, যে শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।

দ্রুত নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে সারা রাতের ক্লান্তি মুছে দিতে চাইলাম। কিন্তু মনের শূন্যতার মেঘ যেন অন্তরজুড়ে বসে আছে। ভাবছিলাম, আর বোধ হয় শেষ দেখা হবে না। কারণ আমি সিলেট থেকে ৩০ তারিখ ঢাকা যাব, তার পর পাবনা। কিন্তু যখন জানলাম, তাঁর বড় ছেলে ও আত্মীয়স্বজনের আসতে দেরি হবে এবং সৎকারের কাজ ৩০ তারিখে; তখন আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ২৯ তারিখ রাতে পাবনার পথে যাত্রা শুরু করি। যথানিয়মে পাবনায় তাঁকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ মিলল।

তাঁর নিজ বাড়িতে ধর্মীয় রীতি সম্পন্ন করে পাবনা টাউন হল চত্বরে তাঁকে (অধুনা স্বাধীনতা চত্বর) বিদায় জানানো হলো। দেওয়া হলো গার্ড অব অনার। মাঠজুড়ে মানুষের ঢল। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন প্রশাসন ও অঙ্গ প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয় সম্মান। পরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেস ক্লাবে নিয়ে আসা হয় এবং দীর্ঘদিনের কলমসৈনিক বন্ধুরা, সহযোগীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।

রণেশদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৯ সালের প্রথমদিকে। ভোরের ডাকের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় বেলায়েত ভাই আমাকে অনুরোধে করেন লেখা সংগ্রহের জন্য। সে-ই প্রথম কলাম লেখার জন্য তাঁর দ্বারস্থ। জানুয়ারির প্রথমদিকে বেলতলা রোডে তাঁর বাসায় যাই। তিনি তাঁর বারান্দায় বসে রোদেলা সকাল উপভোগ করছিলেন। অবশ্য এর আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো; কথা হতো খুব অল্প। চেহারা যেমন, তেমনি তাঁর বাচনভঙ্গি। সুতরাং সহজে তাঁর কাছে যাওয়া বেশ কঠিন। যেহেতু আমি তখন বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন 'সমতা'র সঙ্গে কাজ করি, সেহেতু তাঁর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। কিন্তু তেমন কোনো কথা হতো না।

রণেশদা বরাবরই একজন বাম ঘরানার প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক। তিনি ছিলেন ইতিহাসের চলন্ত ডায়েরি। অবলীলায় সহজ ত্রিকালকে উপস্থাপন করতেন।

তাঁর প্রতিটি লেখা ছিল গাণিতিক সূত্রে গাঁথা। সাবলীল, জুতসই শব্দচয়ন এবং বাক্যবিন্যাস পাঠককে এক লহমায় নিয়ে যেত ঘটনার কাছে। রাখঢাক না করে সত্যকে বেশ কঠিনভাবে উপস্থাপন ছিল তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য। ইংরেজিতে তাঁর অগাধ দখল ছিল। জেলা শহরে অনেকেই ইংরেজি লিখতে জানেন, কিন্তু বলায় তেমন দক্ষ ছিলেন না।

তাঁর রাজনৈতিক মূল দর্শন ছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র, যা সব শ্রেণির মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। তাঁর বড় দুর্বলতার জায়গা ছিল ভূমিহীন জনগোষ্ঠী, আদিবাসী এবং বিশেষ করে যারা মূল স্রোতধারার বাইরে, তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলার। তিনি বরাবর লিখেছেন তাদের অধিকারের কথা, মুক্তির কথা। বিলকুড়লিয়া ও ঘুঘুদহ বিলের খাসজমি আন্দোলনে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। তিনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর আদর্শ ছিল সমাজের অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি। তিনি ওকালতি পেশায় কিছুদিন কাজ করলেও খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় ছেড়ে দেন। গণমানুষের জন্য লড়াই যাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য, তাঁর পক্ষে ওকালতি করা বেশ কঠিন। মুক্ত মানুষ লিখতেন মানুষের মুক্তির গান। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আজীবন লিখেছেন মুক্তির গান। তাই তো তিনি ছিলেন বাতিঘর।

নরেশ মধু: সাংবাদিক ও গবেষক

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image