• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

অতিবৃষ্টি ও ফেনীর অস্বাভাবিক বন্যায় দায় কার?


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শনিবার, ২৪ আগষ্ট, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ০৯:৩৩ পিএম
পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে
অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল

নাভিদ সালেহ:  বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় দেখা দিয়েছে এক অস্বাভাবিক বন্যা। বিশেষত ফেনীর মুহুরী নদী ৭২ ঘণ্টা ধরে বিপৎসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। ত্রিপুরার বেলোনিয়ার কাছে নদীটি ১৮ আগস্ট দুপুরেই বিপৎসীমা পার করেছে। বেলোনিয়া পরশুরামের উত্তরে। মুহুরী নদীটি উত্তর থেকে পরশুরাম হয়ে ফুলগাজী দিয়ে যায়, অতঃপর দক্ষিণে ফেনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়।

রাজেন্দ্রপুরের কাছে ফেনী নদীও এখন বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া নিকটবর্তী ত্রিপুরার নতুনবাজারের কাছে মেঘনা নদী গত ৩০ বছরের সর্বোচ্চ সীমায় প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তরে কুমিল্লার কাছে গোমতী নদী গত আট বছরের সর্বোচ্চ সীমায় বইছে। তারও উত্তরে আগরতলার কাছে হাওড়া নদী এবং ত্রিপুরা পাহাড় থেকে জন্ম নেওয়া খোয়াই নদী বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

ফেনীর ভৌগোলিক অবস্থান ত্রিপুরার ঠিক দক্ষিণে হওয়ায় এ অঞ্চলের প্লাবন হাওড়া, খোয়াই, গোমতী, মেঘনা ও মুহুরী নদীর জলসীমা দ্বারা প্রভাবিত। আবার ফেনী জেলার পূর্বে হৃষ্যমুখের কাছে অবস্থান করছে দেবতামুড়া পাহাড় শ্রেণি, যার উচ্চতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩৫০ ফুট পর্যন্ত। অর্থাৎ অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নেমে আসে ফেনী জেলার দিকে। এমন একাধিক নদী ও ত্রিপুরার পাহাড়ের সহাবস্থান কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলকে বন্যাসংকুল করে তোলে। 

ফেনী নদীকে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশের পানি বণ্টনের ইতিহাসও উল্লেখ করতে চাই। ২০১৯ সালের দ্বিপক্ষীয় পানি বণ্টন চুক্তি ভারতের সাবরুম এলাকার মানুষের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছিল। তবে ভারত ফেনী নদী থেকে কতটুকু জল উত্তোলন করবে এবং তা কে বা কারা তদারক করবে– এসব প্রশ্ন বিতর্কের সৃষ্টি করে। এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ  হয়ে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। নিয়তির পরিহাস এমনই যে, এই আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পরও ফেনী নদীর জল উত্তোলন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়নি; বরং অতিবৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে ত্রিপুরা ও ফেনীর গ্রামাঞ্চল। পানির দাবি নিয়ে এই দ্বন্দ্ব আর আপসের দোলাচলে প্রকৃতিকে কি সত্যিই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে? নিয়ন্ত্রণ কি কখনও করা যায়?

এই অতিবৃষ্টিজনিত বন্যার পেছনে কি জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক রয়েছে? বৈশ্বিক উষ্ণায়নের একটি প্রধানতম ফল হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার তারতম্য। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পর্যায়টি এল নিনো এবং গ্রীষ্ম শেষে তাপমাত্রা হ্রাসের পর্যায়টি লা নিনা বলে পরিচিত। এ দুটি সংঘটন ‘এল নিনো দক্ষিণ দোদুল্যমানতা’ বা ‘এনসো’র এপিঠ-ওপিঠ। এ বছর মে মাসের দিকে বাংলাদেশে তাপদাহের পেছনে ছিল এল নিনোর প্রভাব। আর লা নিনার প্রভাবে এ সময়ে বৃষ্টিপাত বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। এনসোর এই দুই পর্যায়কে তাই বুঝে নেওয়া দরকারি। 

পৃথিবীতলের বেশির ভাগজুড়েই প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থান। এল নিনো-নিরপেক্ষ বছরে এই মহাসাগরের উষ্ণ স্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিম থেকে সরে যায়। ফলে সমুদ্রের গভীর থেকে ঠান্ডা পানি পৃষ্ঠদেশে উঠে আসে এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঠান্ডা রাখে। তবে মহাসাগরীয় স্রোত যদি ধীরগতিতে চলমান হয়, তবে এই ঠান্ডা পানি সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে আসতে পারে না। আর তাই সমুদ্র উষ্ণ হতে থাকে। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের এই উষ্ণায়নের ফল এল নিনো, যার কারণে ভারত উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত কমে যায় আর তাপমাত্রা বাড়ে। ২০২৪-এর জানুয়ারি ছিল গত ১৭৫ বছরের ভেতর উষ্ণতম। তাই এ বছরের এল নিনো ছিল নিকট ইতিহাসের চরম মাত্রার একটি। এই এল নিনোর তীব্রতা যখন কমে যেতে থাকে, তখন লা নিনার প্রভাব দানা বাঁধে। ১৯৫০ সাল থেকেই তীব্র এল নিনোর বছরের পর বলিষ্ঠ লা নিনার পর্যায় দেখা গেছে।

লা নিনার সময় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর দ্রুত ঠান্ডা হয়। ফলে ভারত উপমহাদেশে বৃষ্টিপাত বাড়ে। ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আইআইটি খড়গপুর ও পুনার আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীরা বলছেন, লা নিনার এই শীতলীকরণ পর্যায়ে ত্রিপুরায় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির নজির দেখা গেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সামুদ্রিক ও আবহাওয়া অধিদপ্তর ‘নোয়া’ এ বছর আগস্টে লা নিনা পর্যায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনাকে ৭০ শতাংশে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ ত্রিপুরা রাজ্য ও ফেনী অঞ্চলের এবারের অতিবৃষ্টি হয়তো এই লা নিনার প্রভাবেই ঘটছে। 

এই নিবন্ধ যখন লিখছি, ফেনীতে ৭০টিরও বেশি গ্রাম তলিয়ে গেছে। ত্রিপুরাতে ভূমিধসে সাতজনের প্রাণহানি ঘটেছে। বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। বেড়ে চলেছে মুহুরী, ফেনী, খোয়াই, গোমতী আর মেঘনার নদীসীমা। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বন্যার এই দুর্যোগ ঠেকাতে আমাদের করণীয় কী? কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলের অধিবাসীদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া এবং তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা এখনই জরুরি। ফেনী বাঁধ বা মুহুরী বাঁধ খুলে দেওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। এই বাঁধের সন্নিকটে রয়েছে উড়িরচর, সন্দ্বীপ, ভাসান চর ও ছোট দ্বীপের মতো উপকূলবর্তী দ্বীপাঞ্চল। ফেনী আর নোয়াখালীকে উত্তরের ঢল থেকে বাঁচাতে আমরা যেন দ্বীপবাসীদের প্লাবনের জলে ভাসিয়ে না দিই। আজকের দাবি ফেনীর লাখো মানুষের পুনর্বাসন আর আগামীর দাবি জলবায়ু পরিবর্তনে যতটুকু সম্ভব স্বর উঁচু করা, বিশ্বদরবারে আওয়াজ তোলা।

নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে পুরকৌশল, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক এবং ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন: সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের রচয়িতা

ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ

আরো পড়ুন

banner image
banner image