ড. হুমায়ুন কবির
বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশেই মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এশিয়া থেকে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা থেকে ওশেনিয়া কোথায় নেই মাদকের ভয়াবহতা। উদ্বেগ -উৎকন্ঠা, হতাশা আর কষ্টের শেষ নেই মাদকাসক্ত পরিবারগুলোর। মাদকাসক্তি বর্তমান সময়ে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার দেশে মাদকমুক্ত সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারে ৩.১১অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে "মাদকের বিরুদ্ধে ' জিরো টলারেন্স ' ও চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি অর্থায়নে সংশোধনাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে "। এছাড়াও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং এসডিজি'তেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মাদকদ্রব্যের ইংরেজি পরিভাষা হলো Drug. ড্রাগ বলতে আমরা সাধারণতভাবে ওষুধকেই বুঝি। মাদকদ্রব্য ও ওষুধের মধ্যে চারিত্রিক, গুণগত ও ক্রিয়া- বিক্রিয়াগত পার্থক্য রয়েছে। ওষুধের কাজ হলো জীবদেহে পুষ্টি সাধন, ক্ষয় পূরণ,রোগ নিরাময়,বল বর্ধন, জীবানু নাশ,কষ্ট দূর করা ইত্যাদি। কোনো কোনো মাদকদ্রব্য ওষুধের মতোই জীবদেহের রোগ নিরাময়, বল বর্ধন, কিংবা কোনো কষ্ট বা বিকার দূর করলেও ওষুধের সাথে মাদকের সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ ওষুধ যতই গ্রহণ করা হোক তা কখনোই প্রাণিদেহে 'craving ' বা গ্রহণের জন্য তীব্র আকাঙ্খা তৈরি করে না।
কিন্তু মাদকদ্রব্য লাগাতার কয়েক বার গ্রহণের পরই তা পুনরায় গ্রহণের জন্য গ্রহণকারী প্রাণির মনো-দৈহিক এবং জৈব - রাসায়নিক ব্যবস্হায় 'craving ' বা তীব্র আকাঙ্খা তৈরি হয়। মাদকদ্রব্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটা ব্যবহারকারীর দেহ মনের উপর নানারকম ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়াসহ তার মনস্তাত্ত্ব ও মানসিক প্রবণতা, আচরণ, স্বভাব ও চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মাদকের উপস্থিতি মানুষের আগে। ওল্ড টেস্টামেন্ট, বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনা মতে বেহেশত বা প্যারাডাইসের ' ফিগ ট্রি','অ্যাপল' বা 'গন্দম ফল' ভক্ষণের ফলে আদি পিতা-মাতা আদম- হাওয়ার দেহ,মন,চেতনা, আবেগ,অনুভূতি ও উপলব্ধিতে যে পরিবর্তন হয়েছিল, তা ইহজগতের মাদক সেবনের ফলে মনো-দৈহিক ব্যবস্হায় ঘটে যাওয়া পরিবর্তনেরই অনুরূপ। মাদকদ্রব্য প্রকৃতিরই অবদান।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের সূত্রানুসারে পৃথিবীতে জীব জগতের আগে উদ্ভিদ জগতের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিলো। উদ্ভিদের মধ্যে আবার প্রচীনতম হলো ' ভাইন' জাতীয় লতানো গাছ। এ গাছের মিষ্টি ফলে নিহিত চিনির সাথে বাতাসে ভাসমান ' ইস্ট ' জাতীয় এককোষী ব্যাকটেরিয়ার খাদন এবং গাঁজন ক্রিয়ার ফলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়েছিল বিশ্বের আদিতম মাদক ' অ্যালকোহল'। এ যাবত প্রায় চার হাজার উদ্ভিদের কথা জানা গেছে যেগুলো সরাসরি মাদক কিংবা মাদকের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। ভেষজ লতাগুল্ম, উদ্ভিদের ছাল- বাকল, পাতা, ফুল, ফল বিচি কিংবা এগুলোর নির্যাস থেকে মাদক আহরিত হয়।
তবে নেশার বস্তু হিসেবে ব্যবহার্য এসব ভেষজ কিংবা উদ্ভিদের নির্যাসের পুরোটাই মাদক নয়। এর মধ্যে বিদ্যমান একটি বিশেষ মৌল বা রাসায়নিক উপাদানই মাদক। যেমন অ্যালকোহলের ইথানল, গাঁজার টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল, কোকা পাতা বা কোকেনের একজোনিন, তামাকের নিকোটিন, কফির ক্যাফেইন, পান- সুপারির অ্যারিকোলাইন ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের হাতে মাদকদ্রব্যের নানান পরিশীলন ও বিবর্তন ঘটেছে। প্রকৃতিজাত মাদকের নানা ধরনের রাসায়নিক বস্তুর সংশ্লেষে সিনতেসাইজ করে তৈরি হয়েছে সেমি- সিনথেটিক মাদক।
ল্যাবরেটরিতে নানা ধরনের রাসায়নিক বস্তুর বিক্রিয়া ও সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে সিনথেটিক মাদক। এসব সিনথেটিক মাদকের সাংগঠনিক কাঠামো এবং পারমাণবিক সংখ্যায় হেরফের ঘটিয়ে আবার তৈরি করা হয়েছে ' ডিজাইনার্স ড্রাগ' গোত্রভূত হাজারো নতুন মাদক। বিশ্ব বর্তমানে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি মাদক আছে।
বাংলাদেশে যে সব মাদকের ব্যবহার বেশি সেগুলো হলো হেরোইন, বিদেশি মদ,দেশি মদ,গাঁজা, কোকেন,ইয়াবা, কোডিন (ফেনসিডিল), ইনজেকটিং ড্রাগ এ্যাম্পুল ইত্যাদি। মাদকদ্রব্য জব্দের পরিসংখ্যান থাকে দেখা যায়, দেশে হেরোইন এবং ইয়াবার অপব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাঁজার ব্যবহার ২০১৪-১৭ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বর্তমানে এর অপব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকের সরবরাহ বন্ধ করা বা কমিয়ে আনা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন কাজ। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয় তথাপি প্রতিবেশী দেশসমূহ থেকে নানাভাবে দেশে অবৈধভাবে মাদক ঢুকছে। মাদক কারবারিবা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও সেসকল কৌশল দ্রুত রপ্ত করে দক্ষতার সাথে সফল অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বিচারের মুখোমুখি করছে। এসব কাজ সম্পাদনের জন্য সারাদেশের ৮ টি বিভাগ,৬৪ টি জেলা, ৪ টি মেট্রো কার্যালয় ও ৮ টি বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে যাতে মাদকদ্রব্য দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও কোস্ট গার্ডে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মাদকাসক্তি একটি জটিল কিন্তু চিকিৎসাযোগ্য রোগ। এটিকে একটি ক্রনিক রোগও বলা হয়। মাদকাসক্তি চিকিৎসা অবশ্যই একজন ব্যক্তির মাদক গ্রহণ বন্ধ করবে, মাদকমুক্ত স্বাভাবিক জীবনচর্চা বজায় রাখবে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজে উৎপাদনশীল কাজ অর্জনে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে প্রায় অর্ধ কোটি মাদকাসক্ত থাকলেও সরকারি- বেসরকারি মাদকাসক্ত চিকিৎসা হাসপাতাল (বর্তমানে নিরাময় কেন্দ্র) প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার ফলপ্রসূ চিকিৎসার অভাবও রয়েছে।
কাউন্সেলিং বা থেরাপি মাদকাসক্তি চিকিৎসায় অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলো কাউন্সেলর ও থেরাপিস্টের উপস্থিতিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। অধিকাংশ নিরাময় কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মাদকাসক্তি রিকভারি ব্যক্তি হওয়ায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো প্রফেশনাল বা হাসপাতাল আকারে গড়ে উঠেনি।
বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে প্রায়সই অভিযোগ পাওয়া যায়, তারা রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে, সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নেই, তারা অপচিকিৎসা প্রদান করছে ইত্যাদি। আমাদের দেশে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে পরামর্শ নেওয়াকে অসম্মানজনক মনে করা হয়। মাদকাসক্তি চিকিৎসায় সচেতনতা একটি প্রতিরোধ চিকিৎসা। মাদকাসক্তি চিকিৎসা শুধু একটি চিকিৎসা নয়,বরং অনেকগুলো চিকিৎসার একটি গ্রুপ,যার উদ্দেশ্য যৌথভাবে এসব পদক্ষেপ মাদক অপব্যবহার সমস্যার সমাধান করা, মাদকমুক্তির সাথে সাথে অন্যান্য সমস্যার সমাধান, অপরপক্ষে অন্যান্য সমস্যার সমাধানের সাথে সাথে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন যাপনে সহায়তা করা।
মাদকাসক্তরা আমাদের কারো না কারো আপনজন।
তাদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব পোষণ না করে সহানুভূতিশীল হয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে তাদের চিকিৎসার মাধ্যমে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের সাথে সাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহায়তা করা প্রয়োজন। মাদকমুক্ত সমাজ উন্নত বাংলাদেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এজন্য মাদকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: