আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি। কি এরপরও তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। খুব কম সময়ই সংবাদের শিরোনাম হন তারা। এমনকি মিশরের শারম আল শেখে যেখানে জলবায়ু সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য বিশ্বের বহু দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান মিলিত হয়েছেন, সেই কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনেও নারীদের উপস্থিতি হাতে গোনা, যা অনেকের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের যে লিঙ্গগত প্রভাব রয়েছে তা এরইমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে সৃষ্ট বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগগুলোতে প্রতিবছর অসংখ্য পরিবার আর্থিক দুর্দশার কবলে পড়ে। আর পরিবারের এ আর্থিক দুর্দশার বলি হয় নারীরা। দারিদ্র্যের কারণে মেয়ে শিশুরাই প্রথমে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এছাড়া ভরণপোষণ করতে না পেরে ‘সহজ সমাধান’ হিসেবে মেয়ে শিশুদের বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবারগুলো।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান অ্যাকশনএইডইউকের নতুন এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কেনিয়া, রুয়ান্ডা, জাম্বিয়া ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে লিঙ্গগত সহিংসতা বেড়েই চলেছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। এখানেও সেই নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরুষদের চেয়ে নারীর ওপর বেশি পড়ে। এমনিতেই বেশিরভাগ সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীরা পুরুষের তুলনায় অরক্ষিত অবস্থায় থাকেন। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট কোনো দুর্যোগ নারীকে আরও বেশি বিপদে ফেলে দেয়।
যেমন আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলের রোজমেরির কথাই ধরা যাক। এক সময় কৃষি কাজ করতেন রোজমেরি। কিন্তু এখন তার আর কৃষিকাজের ব্যস্ততা নেই। দিনের বেশিরভাগ সময় তার চলে যায় পানীয় জলের খোঁজে। পরিবারের পানির চাহিদা পূরণে তাকেই বাইরে বের হতে হয়। হাঁটতে হয় কয়েক মাইল বন্ধুর পথ।
উত্তর কেনিয়ায় রোজমেরির এলাকায় বহুদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে পানীয় জলের ৯০ ভাগ উৎসই শুকিয়ে গেছে। তীব্র খরায় ধুকছে পুরো অঞ্চল। শুধু রোজমেরি নয়, তার মতোই বিপাকে পড়েছে ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ নারী।
দীর্ঘমেয়াদী খরা আর পঙ্গপালের উপদ্রবে অতিষ্ঠ উত্তর কেনিয়ার অধিবাসীরা। একসময় রোজমেরির জীবিকার প্রধান উপায় ছিল কৃষিখামার। কিন্তু পঙ্গপালের আক্রমণে তা বারবার ধ্বংস হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে এখন পশুপালন করেন তিনি। কিন্তু এখানে সেই জলবায়ু পরিবর্তনের অবর্ণনীয় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে। পানীয় জল ও চারণভূমির অভাবে সম্প্রতি তার দুটো গরু মারা গেছে। যা তাকে আর্থিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
শুধু রোজমেরির নয়, খরার কারণে তার এলাকার সব কৃষকেরই আয় কমে গেছে। ফলে কৃষি পরিবারগুলোতে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বাল্যবিয়ে দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের এমন অনিশ্চিত সময়ে পরিবারগুলোতে মেয়েদের বাল্যবিয়ের সম্ভাবনা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। যা নারীদের শিক্ষা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার ঝুকিতে ফেলে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ও বিরূপ প্রভাবের শিকার হয়েও রোজমারির মতো নারীরা বসে নেই। তারা জানে কী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু তাই নয়, পরিবেশ ও প্রকৃতির ইতিবাচক বদলের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট তারাই। যেমন রোজমেরি উত্তর কেনিয়ায় স্থায়ীয় অধিকার সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্থানীয় নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করে তার সংগঠন। সেই সঙ্গে মানবাধিকার নিয়ে নারীদের নানাভাবে সচেতন করছে।
স্থানীয় পর্যায়ে এই ধরনের সহায়তা ও সহযোগিতা বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব মোকাবিলায় নারীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোজমেরির মতো নারীরা নিজ সমাজ ও সম্প্রদায়কে নতুন করে গড়ে তুলতে সক্ষম। তবে এক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে প্রয়োজন একটু সুযোগ ও সহযোগিতা।
কিন্তু বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই এসব নারীরা চরমভাবে অবহেলিত। যেমনি নিজ দেশে ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও। এসব নারীরা খুব কমই সংবাদপত্রের শিরোণাম হন। রাজধানীর বড় কোনো হলে তাদের কণ্ঠ শোনা যায় না। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যেখানে বড় বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। এমনকি মিশরে চলমান জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ-২৭-এ তার ব্যতিক্রম কিছু দেখা যায়নি।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: