
মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, নাটোর প্রতিনিধি: দুপুরের সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। হালকা বাতাসে খেজুর গাছের লম্বা পাতা দোল খাচ্ছে। সেই ফাকে সোনালি সূর্যের রঙ্গিন আভা রসের হাড়িতে পড়ে চিকচিক করছে। খেজুর গাছের মাথায় উঠে দড়ি পেঁচিয়ে গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছের মাতি ও ময়লা পরিস্কার করছেন বাবলু প্রামানিক। কোমরের ডান পাশে পেঁচানো দড়িতে ছোট্ট বাঁশের খাঁচিতে কিছু ধারালো বাটাল আর পেছনে রসের হাড়ি ঝোলানো তাঁর।
খেজুর গাছ থেকে নেমে আসতেই ক্লান্ত মুখে মুচকি হেসে বললেন, এখন শুধু বেগার (আয় নেই) খাটতেছি, রস হবে আরও আট দশদিন পরে। যে রস হচ্ছে তা থেকে অল্প লালি গুড় তৈরি হচ্ছে।
রাজশাহীর বাঘা জেলা থেকে শীতের মৌসুমে এসে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার সুইস গেট এলাকায় একাই ৫০ থেকে ৬০ টি খেজুর গাছ লাগান বাবলু। প্রতিটি গাছের জন্য মালিককে খাজনা দিতে হয় ১৫০ টাকা সাথে টাটকা রসও খাওয়াতে হয়। রসের মৌসুমে (৪ মাস) গুড় বিক্রি করে খরচ বাদে লাখ খানেক টাকা বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন তিনি, মাটির হাড়ি নিয়ে হাটতে হাটতে এসব কথা বললেন বাবলু প্রামানিক।
পরিস্কার, সুমিষ্ট এবং অধিক রসের জন্য গাছের কাটা অংশ নিয়মিত চাঁছ দিতে হয়। যে কারণে প্রয়োজন হয় ধারালো বাটাল ও হাসুয়ার। আরও একটি গাছ লাগিয়ে এবার শানে বালু ফেলে বাটাল ধার করতে বসলেন বাবলু। বললেন, ভালো রসের জন্য মাটির হাড়ি ভালোভাবে পরিস্কার করে পরিমিত পরিমাণে চুন দিতে হয়।
বিলদহর চাঁচকৈড় সড়ক দিয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছীরা। কাজের ফাঁকে গাছি রান্টু বললেন, বাবলু, আজিজুলসহ আরও ৬ জন গাছী রাজশাহী জেলার বাঘা থানা থেকে এসেছেন গুরুদাসপুরের সুইচ গেট এলাকায়। যারা গাছ খাজনা করে নিয়ে রস সংগ্রহ করেন এবং গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন। শীতের মৌসুম আসলেই বাঘা থেকে গাছ লাগাতে চলে আসেন তারা। সুইচ গেটের কাছে একটি ঘর নিয়ে সবাই মিলেমিশে থেকে এভাবে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন তারা। মৌসুমে (চার মাস) গুড় বিক্রি করে খরচ বাদে একেকজন ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা আয় করেন।
গাছীদের দেওয়া তথ্যনুসারের ফজরের আযানের শেষে গিয়ে দেখা যায়, খেজুর গাছ থেকে রস নামোনো শুরু করছেন আজিজুল হকসহ অন্যান্য গাছিরা। আজিজুল বললেন, গাছ থেকে রস নামোনোর জন্য রাত সাড়ে তিনটার দিকে উঠতে হয়।
খেজুরের মিষ্টি রস খাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে কাঁচের গ্লাস নিয়ে এসেছেন ওই এলাকার হাফিজুল ও আনিক। পলিথিনে জড়িয়ে নিয়েছেন বাড়িতে ভাজা মুচমুচে মুড়ি। গাছীর কাছে রস কাঁচের গ্লাসে নিয়ে ঢেলে দিলেন মুড়ি। রসে চুমুক দিয়েই বললেন, আহ, দারুণ!
ওদিকে, হাড়ির রস গাছ থেকে নামিয়ে ড্রামে ভরে বাঁকে বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাটির তৈরি চুলার কাছে। চারকোনা লম্বা চুলোতে বসানো হয়েছে টিনের তাওয়া। খেজুর গাছের ডালপাতার জ্বালে ধুয়া উঠছে চুলা দিয়ে। হাড়ি ও ড্রামের রস ছেকে ছেকে ঢালা হচ্ছে তাওয়ায়। চুলায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতেই রসের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসলো।
পরের প্রক্রিয়া কি জানতে চাইলে আজিজুল বললেন, রস জ্বাল করে লালী গুড় (আঠালো তরল গুড়) তৈরি করা হয়। এরপর মাটির ও টিনের ছাঁচে লালী ফেলে পাটারীসহ অন্যান্য ধরণের খেজুরের গুড় তৈরি হয়। রস কম হওয়ায় এখন একটি তাওয়ায় জ্বাল করা হচ্ছে। দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর রসের পরিমাণ বেড়ে যাবে, তখন আরও দুটি তাওয়া বসানো হবে রস জ্বাল করে খেজুর গুড় তৈরি করার জন্য।
আবহমান কাল থেকে বাংলায় নবান্নের উৎসব পালনে খেজুর গুড়ের কদর বেশি। তাই শীতের আমেজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চলনবিলাঞ্চলের গাছিরা খেজুরের রস আহরণের জন্য গাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, গাছিরা গাছ পরিষ্কার করার জন্য গাছি দা ও দড়ি তৈরিসহ ভাড় (মাটির ঠিলে) ক্রয় ও রস জ্বালানো জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
গাছিরা বলেন, শীত চলে আসছে। এখন খেজুর গাছ তোলার সময়। খেজুর রসের গুড়-পাটালি তৈরি করে সিংড়া, চাচকৈড়, নাটোর, মৌখাঁড়া, তেবাড়িয়া, নলডাঙ্গা, আহসানগঞ্জ ও তাড়াশ বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করা হয়। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। এতে আমরা অনেক লাভবান হয়ে থাকি।
সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সেলিম রেজা বলেন, খেজুর গাছ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। উত্তরাঞ্চলের খেজুর গুড়ের চাহিদা দেশজুড়েই। খেজুর গুড়ের মধ্যে পাটালী আর লালীই বেশি প্রসিদ্ধ।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনর রশিদ বলেন, উপজেলায় ৫০ হেক্টর জমিতে মোট ১১ হাজার ২৫০টি খেজুরের গাছ আছে। এসব গাছ থেকে মৌসুমে ৪’শ মেট্রিক টন খেজুরের গুড় উৎপাদন হয়।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: