• ঢাকা
  • বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: রবিবার, ০৫ জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৩:০৭ পিএম
একাত্তর সালে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর
মুক্তিবাহিনীর বাইরে ‘মুজিব বাহিনী’

প্রভাষ আমিন

একাত্তর সালে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর বাইরে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক। তারুণ্যদীপ্ত এই বাহিনী বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারও নেতৃত্ব মানতে চাইতো না। এ নিয়ে তখন কিছু ভুল বোঝাবুঝিও ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না। একাত্তর সালে কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন একবছরের মধ্যেই সিরাজুল আলম খানের হাতে গড়া জাসদ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পথে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। c থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, ঈদের জামাতে এমপি খুন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হামলা, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার মতো অপরাজনীতি করেছিল জাসদ। এমনকি ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর জাসদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আসলে জাসদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী বিরোধিতার জন্য।

৭২-৭৫ সময়ে জাসদের রাজনীতি যারা দেখেছেন, তারা কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন, জাসদ একদিন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সঙ্গী হবেন। জাসদের আ স ম আব্দুর রব বা হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী হবেন। যেমন, আ স ম আব্দুর রবের কথাই ভাবুন। একসময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, তারপর জাসদের নেতা হয়েছেন। এখনও তিনি জাসদের একটি অংশের নেতা। কিন্তু একজন নেতা তার জীবনে কতবার রূপ বদলাতে পারেন? একসময় বঙ্গবন্ধুর শিষ্য ছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক ছিলেন। জিয়ার অনুগ্রহে জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসা পেয়েছেন। এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন। এখন আবার তিনি শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচক। মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ করেছেন, বাসদ করেছেন, আওয়ামী লীগ করেছেন। এখন পারলে শেখ হাসিনাকে টেনে নামান।

অত পেছনে গেলে অনেকে হয়তো রিলেট করতে পারবেন না। আরেকটু কাছে আসি। ৯০’র ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের সময় কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন, পতিত এরশাদ আবার রাজনীতিতে ফিরবেন। পতিত হওয়ার ১০ বছরের মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবেন। এরশাদ আবার শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলোচনা করবেন, রাজনীতি করবেন। জাতীয় পার্টির তখনকার বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রী, ৬ ডিসেম্বর যারা বোরখা পরে পালিয়েছিল; তারাও যে আবার মন্ত্রী-এমপি হবে সেটা আমি কখনও কল্পনা করিনি। এখন দেখি আমি বোকার হদ্দ। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই নেতারা বলেন, অত কিছু বুঝবেন না। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

রাজনীতিতে শেষ কথা নেই, এই কথা বলে কত কিছু যে জায়েজ করা যায়। বামদের সাথে মিলে ১৪ দলীয় জোট আর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট করে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ বরাবরই বাংলাদেশের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ যখন হেফাজতে ইসলামের মতো দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করে, অনেকে অবাক হন। আমি অবশ্য অবাক হই না। রাজনীতিতে এত অবিশ্বাস্য সব ঘটনা দেখেছি, কিছুই আর অবাক করে না। এবারই প্রথম নয়, ২০০৬ সালে না হওয়া নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগ ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে ঐক্য করেছিল। বিএনপি জামায়াতের সাথে জোট বেধে ভোট পাচ্ছে ভেবে আওয়ামী লীগও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কাছে টেনেছে বিভিন্ন সময়।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন ‘বীরউত্তম’। কিন্তু তার সময়েই স্বাধীনতাবিরোধীরা পুরস্কৃত হয়েছে, পুনর্বাসিত হয়েছে। বিএনপিই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দিয়েছে। স্বৈরাচার পতনের পর বিএনপি দুই দফায় ক্ষমতায় এসেছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর আশীর্বাদ নিয়ে। জামায়াতের সাথে বিএনপির জোট নিয়ে বছরের পর বছর অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাঁঠালের আঠা মার্কা প্রেমের সমাপ্তি ঘটেনি। বাস্তবে সংখ্যা যাই হোক, অনেকদিন ধরেই কাগজে-কলমে ২০ দলীয় জোট নিয়ে রাজনীতি করছে বিএনপি। এরমধ্যে অনেক দল জোট ছেড়েছে। কিন্তু সংখ্যা কমেনি। সংখ্যা যাই হোক, জোটের নামই ‘২০ দলীয় জোট’। এই দলে কার্যত দল দুটি বিএনপি আর জামায়াত। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট রেখেই বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার সময় বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশের অসাধারণ সংবিধানটি প্রণীত হয়েছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তার। সেই ড. কামাল হোসেন যখন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেন আমি অবাক হই না। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের দলের প্রতীক আর জামায়াতের প্রার্থীদের প্রতীক অভিন্ন ছিল। ড. কামাল যখন ধানের শীষের পক্ষে ভোট চেয়েছেন, তখন তিনি আসলে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষেও ভোট চেয়েছেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অটো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু জামায়াতকে সাথে নিয়ে গড়া জোট ২০ দলীয় জোট ছিল এবং আছে। এই জোটকে পাশে রেখেই বিএনপি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু গণসংহতি আন্দোলন বা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি যখন বিএনপির সাথে সরকার বিরোধী জোট নিয়ে আলোচনা করে, একটু খটকা লাগে। দীর্ঘদিন বাম জোটে থাকা দল দুটি কেন হঠাৎ ইউটার্ন করে ডান জোটে চলে যাচ্ছে। কমরেড সাইফুল হক আর কমরেড জোনায়েদ সাকিকে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, বিএনপির সাথে জোট বাধা মানে কিন্তু জামায়াতের সাথেও জোট বাধা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ড. কামাল এই বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে না পেরে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তবে তারা জেনেশুনে গেলে আমার কোনও আপত্তি নেই। রাজনীতিতে কে কার সাথে জোট বাঁধবে, সেটা তার নিজস্ব এখতিয়ার।

এখনকার রাজনীতির আরেক আলোচিত চরিত্র ড. রেজা কিবরিয়া। তিনি উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ড. রেজা কিবরিয়ার পিতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে এক গ্রেনেড হামলায় মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর সময়ও আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া এখন আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় সমালোচক। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গণফোরামে যোগ দিয়ে তিনি নির্বাচনও করেছিলেন, হেরেও গিয়েছিলেন। দ্রুতই তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক বনে যায়, তারচেয়েও দ্রুতগতিতে গণফোরাম ত্যাগ করেন। এখন তিনি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের দল গণঅধিকার পরিষদের আহবায়ক। বাবা যেই দল করবেন, ছেলেকেও সেই দল করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। বাবার আদর্শ আর ছেলের আদর্শ আলাদা হতে পারে।

এমনকি ৯৬ সালের আওয়ামী লীগ আর ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগ যে এক নয়, সে কারণেও তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে পারেন, শেখ হাসিনার পতন চাইতে পারেন। কিন্তু যে দলটির বিরুদ্ধে তার পিতার হত্যার ষড়যন্ত্র, যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা, বিচার কাজ এগিয়ে না নেওয়ার অভিযোগ সেই বিএনপির সাথে মিলে যখন রেজা কিবরিয়া আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে চান; আমি অবাক হই না। কোনোদিন যদি আওয়ামী লীগ আর বিএনপি জোট বাঁধে, তাতেও আমি অবাক হবো না।

আসলেই রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image