অলোক আচার্য
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি যে দৃশ্যটি ছড়িয়েছে তা হলো খালি গায়ে একজন মানুষকে খাওয়ানোর দৃশ্য। মানুষটি হাত ধুয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করেছে। চোখে মুখে আতঙ্ক থাকলে মৃত্যুভয় দেখিনি। এর পরের দৃশ্যপট এর থেকেও ভয়ঙ্কর এবং নৃশংস। কারণ এর পরের দৃশ্যেই তাকে আবার পেটানো হয় এবং এর ফলে তার মৃত্যু হয়। আচ্ছা যদি সে জানতো এরপর তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে তাহলে কি সে ভাতটুকু খেতে পারতো? সে কি আক্রমণকারীদের বিশ্বাস করেছিল? বিশ্ববিদ্যালয় হলো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এবং লাখ লাখ ছেলেমেয়ের কাছে এবং তাদের অভিভাবকের কাছে সন্তানকে লেখাপড়া করানোর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় হলো উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সর্বশেষ ধাপ। আমরা মানে সাধারণ জনগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে আসলে কি আসা করি? সত্যি বলতে একজন যখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তখন তার এক ধরনের ভ্যালু সৃষ্টি হয় এবং সমাজ তার থেকে কিছু প্রত্যাশা করে। তার হাত ধরেই পরিবর্তন আসবে এমন আশাই করা হয়। এখান থেকেই সে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে বের হয় এবং দেশের সেবা করার জন্য প্রস্তুত হয়। সেই সাথে ধরেই নেওয়া হয় যে একজন মানুষ হিসেবে সে প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ আজকের চিত্র যেন ঠিক এই ধারণার বিপরীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন আবরার বা তোফাজ্জলের মতো কোনো মানুষ, ছাত্র বা যে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করে তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে বিশ্ববিদ্যালয় কতটা নিরাপদ। সে প্রশ্নের উত্তর যাই হোক আপাতত তোফাজ্জলের মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়েছে এবং তাকে পিটিয়ে হত্যার আগে খাওয়ানোর দৃশ্যটা ভাইরাল হয়েছে। একটা মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার আগে যে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ানো হয় এরকম উদাহরণ আগে ছিল বলে আমার জানা নাই। তবে উদাহরণ তৈরি হয়েছে। এসব মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় নামক পবিত্র স্থানগুলো কলঙ্কিত হয়েছে। মানুষ হিসেবে আমরা যে কোনো দল, মত বা ধর্ম বা গোষ্ঠীর চেতনা ধারণ করতেই পারি কিন্তু এই মানুষ হিসেবেই আমাদের মনুষ্যত্বকে ধারণ করতে হবে। অথচ আমরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাড়ি দিয়েও মনুষ্যত্বের দেখা পাইনি।
যাদের নিয়ে আমাদের গর্ব করার কথা আমরা কিন্তু তাদের নিয়ে গর্ব করতে পারছি না। কেন পারছি না? শুধু আমরা কেন? যে বাবা মা তার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়েছেন, হয়তো গর্ব করে সবাইকে বলেছেন তার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে, সেই বাবা মায়ের মাথা সমাজের কাছে নত করেছে তাদেরই আদরের সন্তান। তারা তো টেরই পাননি যে কবে, কখন যে তার আদরের সন্তানের ভিতর একটু একটু করে অমানুষ বাসা বেঁধেছে, কখন যে তারা তাদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে একটা দানব তৈরি হয়েছে। একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে সমাজ বা রাষ্ট্র যা প্রত্যাশা করে আমরা আসলেই সেই সেবা বা আচরণ কোথাও দেখছি না। আমরা রাজনীতি বুঝি কিন্তু পিটিয়ে হত্যা নীতি বুঝিনা, মানি না মানতেও চাই না। প্রতিটি হত্যা, প্রতিটি জীবন মহামূল্যবান এবং অপরাধী হলে বিচারের পথ আছে দেশে। তারপরও যারা ঠান্ডা মাথায় পেট ভরে খাইয়ে দাইয়ে বেধড়ক পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে তাদের হাতে কলম মানায় না। এরাই সমাজের আবর্জনা, পঁচা দুর্গন্ধের নাম। খোলস পাল্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে এবং এতে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। দেশে বিদেশে যখন এসব খবরগুলো যায় তখন আমাদের লজ্জা হয়। যদিও পিটিয়ে মানুষ মারার মত ঘটনা এদেশে হয়। গরু চোরদের গণধোলাই দেওয়ার খবর শুনি, ছিনতাইকারীকে গণধোলাই দেয়ার খবরও আছে কিন্তু সেসব তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা সেই প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে না। সেসবও মানবতাবিরোধী অপরাধ। কারণ কোনো বিচার বহির্ভূত অপরাধই মানবতা সমর্থন করে না। তবে ছাত্ররা মিলে একজন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় পিটিয়ে মেরে ফেলছে এই দৃশ্য কোনো সুস্থ সমাজের হতেই পারে না। এ জন্যই বলছি, সমাজটা পঁচে গেছে। ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। আর ক্যান্সার এমন জায়গায় পৌছে গেছে তা একেবারে উপর অব্দি পৌছে গেছে। তাহলে এই সমাজটাকে পথ দেখাবে কারা? উচ্চ শিক্ষার স্থান এবং সেই মানুষগুলোই যদি পথভ্রষ্ট হয় তাহলে বাকি মানুষ কার কাছে দাঁড়াবে?
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বটেই কোনো পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকেই নৃশংসতা আশা করি না। এই তো কয়েকদিন আগেই দেশের ছাত্রছাত্রীদের দেখেছি হাতে হাত রেখে বন্যার্তদের সহযোগীতা করতে এগিয়ে এসেছে। দ্বারে দ্বারে ঘুরে সাহায্য জোগাড় করছে। এই চিত্রটাই তো প্রকৃত চিত্র। আর বিশ্ববিদ্যালয় হবে সেই মানবতার কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে তাহলে অভিভাবকদের আস্থায় টান পরবে। কি লাভ তবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে? কি লাভ দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে? আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে আর কলঙ্কিত হতে দিতে পারি না। এই প্রবণতা রোধ করতেই হবে।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: