সুমন দত্ত
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। ৫০ বছর পার হলেও দেশটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে পারেনি। সম্প্রতি রাশিয়ার জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না পারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক ব্যর্থতা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব আজ বিভক্ত। এমন এক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে কাজ করা কঠিন ছোট দেশগুলোর জন্য। আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভয়ে রাশিয়ার সঙ্গে এমন আচরণ করছে। অথচ ইতিহাস বলছে রাশিয়া বাংলাদেশকে জন্ম লগ্ন থেকে সাহায্য সহযোগিতা করছে।
রাশিয়ার বহু জাহাজকে বাংলাদেশ প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যা ছিল নজিরবিহীন। তাতে মনে হলো বাংলাদেশ আমেরিকান জোটে চলে গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য চুক্তিগুলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের আগে করা। তাই সেই সব চুক্তি পূরণের জন্য আমেরিকা বাধা হতে পারে না। এটা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের দেশের সরকার।
বাংলাদেশ আমেরিকাকে বলতে পারতো, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। নতুন কোনো চুক্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে যাবো না। সেটা মানলে তা হতো সম্মানের। বাস্তবে তা হলো না। এখন বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি নিয়ে আমেরিকার ইচ্ছা পূরণ করতে হচ্ছে। রাশিয়ার জাহাজ ভারত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে গেল।
আমেরিকা মাঝে মাঝে এমন সব আবদার করে যা মামা বাড়ির আবদারের মতো। মনে হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে এই মামা বাড়ির আবদার মেটানোর জন্য।
ভারতের সঙ্গেও এই মামা বাড়ির আবদার করেছিল আমেরিকা।
মুম্বাইয়ের বন্দরে নোঙর করা রাশিয়ার বেশ কয়েকটি জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আমেরিকা। ভারতে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল সেই আপত্তি। ভারত তার জবাবে বলেছিল, আপনারা এসব না বলে আপনাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলুন। তারপর সিদ্ধান্ত হবে। উত্তর পেয়ে মার্কিন অ্যাম্বেসি ও তাদের পররাষ্ট্র দফতর আর এসব নিয়ে উচ্চবাচ্চ করেনি।
অনেক আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষক ভারত কে মার্কিন ছাড়ের বিষয়টি, ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধের প্রেক্ষাপটে দেখেন। হয়ত এটা একটা কারণ। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় এজেন্ডা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসলামিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত এক মঞ্চে। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না ভারত এই এজেন্ডা থেকে বের হয়ে যাক।
এদিকে আফগানিস্তানে তালেবানদের সহায়তা করছে ভারত যা আমেরিকার পক্ষে যাচ্ছে। আফগানিস্তান কে যেভাবে ফেলে আসে আমেরিকা, তাতে সেখানে রক্তপাত ছিল অবধারিত। খাদ্য সংকট ছিল চরমে। ভারত সময়মত সহায়তা করায় সেই সংঘাত হয়নি। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার খড়গ তালেবান সরকারের ওপর ঝুলছে।
ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দিনকে দিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। রাশিয়ার পরই ভারত ইসরাইল থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কিনে। আর আমেরিকার রাজনীতিতে ইসরাইল একটা ফ্যাক্টর। মার্কিন কোম্পানি গুলোতে ইসরাইলিদের একটা দাপট রয়েছে। তাই ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা সময় বলে দেবে। সেই ঝুঁকি কোনো মার্কিন সরকার নিতে চাইবে না।
ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকা কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারার আরেকটি কারণ প্রবাসী ভারতীয়দের মার্কিন সমাজে প্রভাব। শীতল যুদ্ধের সময় এমনটা ছিল না। এখন মার্কিন কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ ও উচ্চ কক্ষ সিনেটে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বেশ কয়েক জন আইন প্রণেতা রয়েছেন। তাছাড়া বিরোধী রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট আইন প্রণেতাদের অনেকে প্রবাসী ভারতীয়দের অর্থ নিয়ে নির্বাচন করেছেন। তাই তাদের চটিয়ে ভারত বিরোধী আইন পাস করানো এখন মার্কিন সরকারের জন্য কঠিন।
মার্কিন শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চস্তরে একটা বিশাল গ্যাপ রয়েছে। সেখানে মেধাবী ভারতীয়রা বসে রয়েছে। ওই স্তরে বিশাল একটা ভারতীয় সমাজ গড়ে উঠেছে। আজ দুনিয়া শাসন করা মার্কিন টেক কোম্পানি গুলোর সিইও ভারতীয়। সেখানে বিপুল সংখ্যায় কাজ করছে ভারতীয়রা। ভারতের বিশাল বিনিয়োগ আছে এই টেক কোম্পানিগুলোর ওপর। তাই যুক্তরাষ্ট্র কখনই ভারত বিরোধী এজেন্ডায় নিজের নাম লেখাতে চাইবে না। এতে তার অনেক জায়গায় ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই ভারতের চীন বিরোধী রাজনীতি থাকুক কিংবা না থাকুক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত সম্পর্ক খারাপ হবার নয়। ভারত মার্কিন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ভাবে। অন্য দেশের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক এমনটা নয়। তাই ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ধরনের ছাড় পাবে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নও পাবে না।
যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতকে তার বন্ধু জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের মর্যাদা দিয়ে থাকে। সেই অবস্থানে নেই ন্যাটো জোটের দেশগুলো। এ কারণে কোয়াড এর মধ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গঠিত হয়েছে। এখানে ন্যাটো বিকল। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র ব্রিটেন। বর্তমান ব্রিটেনের রাজনীতি হচ্ছে ভারত ঘেঁষা। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট্ওে রয়েছে একাধিক প্রভাবশালী ভারতীয়। ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে ব্রিটেনে। ব্রিটেনে বিনিয়োগ রয়েছে ভারতের। এছাড়া ব্রিটেন ব্রেক্সিট করার পর একমাত্র ভারতই বাঁচাতে পারে ব্রিটেনের অর্থনীতিকে। তাই এমন সংকটময় অবস্থায় ব্রিটেন কখনই ভারত বিরোধী অবস্থানে যাবে না। আর ব্রিটেন না গেলে আমেরিকার ভারত বিরোধী হবার প্রশ্ন উঠে না।
জ্বালানির উচ্চ দামে ব্রিটেন ভারতের মাধ্যমে রাশিয়ান তেল কিনছে। যা এর আগে আমেরিকার কোম্পানিগুলো করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিবৃতিতে এই সত্য বেরিয়ে এসেছে। মনে রাখা উচিত আমেরিকা যখন কারো বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় তখন তাতে ব্রিটেন সবার আগে সমর্থন করে।
অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার পরমাণু পরীক্ষা চালালে ভারতের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয় বিল ক্লিনটন সরকার। ব্রিটেন তাতে বিরত থাকে। আর এটা দেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্টপ হয়ে যায়। একই কাজ পাকিস্তান করলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পড়ে সঙ্গে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও দেয়।
ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ একমাত্র থামাতে পারে ভারত। আমেরিকা ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন পারে এই যুদ্ধে ঘি ঢালতে। এটা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বুঝে গেছে। এ কারণে তিনি যুদ্ধ বন্ধে ভারতের সহায়তা চেয়ে বেশ কয়েকবার মোদীর সঙ্গে কথা বলেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও চান এ নিয়ে ভারতের মধ্যস্থতা। কারণ ভারতের চেয়ে বিশ্বস্ত রাশিয়ার এই মুহূর্তে কেউ নেই।
তাই হলফ করে বলা যায় আমেরিকা ভারতকে কখনই বিরোধী শিবিরে দেখতে চাইবে না। আমেরিকার নিজের প্রয়োজনে ভারতকে দরকার। চীনের সঙ্গে ভারতের যে ধরনেরই সম্পর্ক থাকুক। আমেরিকা কখনই ভারতকে উপেক্ষা করতে পারে না। আমেরিকার রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে ভারত। এক সময় ইসরাইলি লবি ছিল আমেরিকায় শক্তিশালী। সেটি কে এখন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ভারত। তাই নির্বাচনের আগে ভারতের বিনিয়োগ কোন রাজনৈতিক দলের ওপর তার গুরুত্ব বহন করে দেশটির রাজনীতিতে। টেক্সাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে হাউডি মোদি সম্মেলন অন্যতম। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় ভারতকে মার্কিন ছাড় চীনকে কেন্দ্র করে নয়।
লেখক : সাংবাদিক সময় ১৫ জানুয়ারি রবিবার
ঢাকানিউজ২৪.কম / এসডি
আপনার মতামত লিখুন: