• ঢাকা
  • বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

নিত্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটে যারা


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৮:১২ পিএম
নিত্য পণ্য
নিত্য পণ্য

সুমন দত্ত

 দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সাধারণ মানুষের কষ্ট যখন চরমে তখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে আগামীতে দুর্ভিক্ষ হতে পরে। আর এটা বলার পরই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির পালে হাওয়া লাগে। 

এ দেশের বাজারে যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে বা আসবে, তখন রাতারাতি মুদি দোকানিরা ও নিত্য পণ্যের ডিলাররা পুরানো দামের ওপর নতুন দাম বসিয়ে বিক্রি করতে থাকে।

বিপরীতে দাম কমার ঘোষণা আসলে, ওই একই মুদি দোকানি ও ডিলার পুরান দামেই পণ্য বিক্রি করেন। যুক্তি হিসেবে বলেন, নতুন কমানো দামের মাল তারা কোম্পানি থেকে এখনো পাননি। এই ধরনের শয়তানি বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না।  

এদের ঠেকানোর জন্য সরকার একটি লোক দেখানো সংস্থা তৈরি করেছে। যার নাম ভোক্তা অধিকার। যার চোখ রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ীদের ওপর পড়ে না। পড়ে চুনোপুঁটিদের ওপর। আর ওই চুনোপুঁটিকে মিডিয়াতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়।   

আমাদের রাজনীতিবিদরা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ এই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো রাষ্ট্র না। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এই মূল্যবৃদ্ধি। 

এটা সত্য বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম এক রাষ্ট্র। তবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ চলে কি? তেমনি এদেশের অর্থনীতি শেয়ার মার্কেট বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ে কমে কি?

 প্রশ্ন উঠে, শুক্র-শনি রাষ্ট্রীয় ছুটি বিশ্বের কতটি দেশে আছে? সাংবাদিক হয়ে আমি জানি না সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় ছুটি ২ দিন কোনো দেশের আছে কিনা। থাকলে থাকতেও পারে। আমার কাছে বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় ছুটি সপ্তাহে ২ দিন।

 বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই রাষ্ট্রীয় ছুটি সপ্তাহে একদিন। আর সেটা রবিবার। আমাদের দেশে দুদিন এবং শুক্র শনি হওয়ার কারণে রবিবার পর্যন্ত আন্তর্জাতিক লেনদেন বন্ধ থাকে। অর্থাৎ সপ্তাহে তিন দিন আন্তর্জাতিক লেনদেন এদেশে বন্ধ থাকে। এতে প্রমাণিত হয় বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে না আমার দেশের অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিলে তিন দিন লেনদেন বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকতো না।      

বাংলাদেশের শেয়ার বাজার বেশ কয়েকবার ধসের শিকার হয়েছে। এমন ধরনের ধস বিশ্বের কয়টি রাষ্ট্রে হয়েছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা চুরির ইতিহাস কয়টি রাষ্ট্রের আছে? দুর্নীতিতে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড কয়টি রাষ্ট্রের আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে কেউ বলতে চাইবে না বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশ চলে তার নিজস্ব স্টাইলে। যে স্টাইল ইউনিক। তাই বিশ্ব মন্দার দোহাই দিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের দুয়ার আরো বেশি প্রশস্ত করে দিচ্ছেন আমাদের শাসক দলের রাজনীতিবিদরা। যার কারণে জনগণ আজ এই সরকারের বিরুদ্ধে বিরক্ত ও হতাশ।

 আর এমনটাই বা হবে না কেন? কাটা গাছের বীজরোপণ করলে সেখানে কাটা গাছই তৈরি হবে। ফলের গাছ নয়। দুর্নীতির মাধ্যমে যে সরকার নির্বাচিত তারা দুর্নীতিবাজদের পক্ষেই কাজ করবে। সাধারণ জনগণের জন্য কখনই নয়।


আজ দেশে খাদ্যের কোনো সংকট নেই। তারপরও জনগণ খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতেও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামবৃদ্ধি ঘটেছে। তবে আমাদের মতো নয়।

২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার তারিখে ভারতে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৩০ টাকা। সেখানে বাংলাদেশে সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৮৫ থেকে ২০০ টাকা।  

ভারতের বাজারে প্রতি কেজি চিকন চাল, নাম বাঁশকাঠি বিক্রি হচ্ছে ৬৩ টাকা কেজি প্রতি। বাংলাদেশে চিকন চাল ৮৫ টাকা কেজি প্রতি।

ভারতে পোলট্রির ডিম প্রতি পিছ ৫ টাকা। আর বাংলাদেশে ডিম ১০ থেকে ১৪ টাকায় উঠানামা করছে। 

ভারতে চিনি প্রতি কেজি ৪৫ টাকা। বাংলাদেশে চিনি প্রতি কেজি ১০৫ থেকে ১১০ টাকা।

 ভারতে আটা প্রতি কেজি ৩৬ টাকা। বাংলাদেশে আটা ৭৪ থেকে ৮০ টাকায় উঠানামা করছে।

 পাঠক হয়ত খেয়াল করেছেন বাংলাদেশে এসব নিত্য পণ্যর দাম ভারতের দ্বিগুণ। কোনোটির দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ আমাদের টাকার মান কিন্তু ভারতের দ্বিগুণ না। বাংলাদেশি ১০০ টাকা ভারতের ৮০ টাকার সমান। কখনও এটা ৮৫ টাকাও থাকে। 
সেই হিসেবে ভারতে প্রতিটি নিত্য পণ্যের দাম বাংলাদেশে সামান্যই বৃদ্ধি হতে পারে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রতিটি নিত্য পণ্যে ভারতের চাইতে দ্বিগুণের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যা অস্বাভাবিক। আর এখানেই কবি নীরব। 

কেন এমনটা হচ্ছে? এর পিছনের ইতিহাস জানতে গেলে বুঝতে হবে কয়েকটি পরিবর্তনের কথা। 


বাংলাদেশে এক কালে যারা বিড়ির ব্যবসা করত তারা এখন নিত্য পণ্যের ব্যবসায়ী হয়েছে। তেমন ওষুধ বিক্রি করে যারা হাত পাকিয়েছে তারাও নেমেছে ওই নিত্য পণ্যের ব্যবসায়। এভাবে আবাসন ব্যবসায়ী, মোটর পার্টস ব্যবসায়ী, তেল ব্যবসায়ী। যারা অতীতে কোনো সময়েই টাকা পয়সা থাকা সত্ত্বেও এসব ব্যবসা করেনি তারা এখন নিত্য পণ্যের ব্যবসা করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ থেকে এদেশে চাউলের বাজার ও পেয়াজের বাজার ছিল অস্থিতিশীল। তখন করোনার অজুহাত দেওয়া হয়েছিল। দেশে পর্যাপ্ত চাউল উৎপাদন হলেও কমছিলও না চালের দাম। দিনে দিনে সেটা বেড়েই চলছিল। 

এরপর রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। বাংলাদেশ কখনই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে চাউল আমদানি করে না। বরং বাংলাদেশ দীর্ঘদিন চাউল আমদানি বন্ধ রেখেছে নিজেদের বাজার ধরে রাখতে। সেই অনুসারে চাউলের উৎপাদন হচ্ছিল। 

তখন প্রচার করা হলো দেশে চাউলের কোনো ঘাটতি নেই। বরং বাংলাদেশ চাউল রপ্তানি করবে। এমন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই চাউলের দাম বাড়তে থাকে। 

কেন বাড়তে থাকে? এই প্রশ্ন খাদ্যমন্ত্রীকে করলে তিনি বলেন মিল মালিকদের কথা। 

এদিকে কৃষক ধান চাউলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। তাহলে ধান চাউল থেকে লাভ করছে কারা?  


খোঁজ নিয়ে জানা গেল অতীতে যারা বিড়ির ব্যবসা করত, তারা এখন নেমেছে চাউলের ব্যবসায়। বিড়ি বিক্রির মুনাফা, চাউলের ওপর এমনভাবে প্রয়োগ করল, বাজার থেকে সব চাল রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল। এখন সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে ধীরে ধীরে সেই চাউল আবার বাজারে ছাড়া হলো। 

এখন এই বিড়ি ওয়ালার ব্যবসা দেখে ওষুধ ওয়ালারা নামল চাউলের ব্যবসায়, নামলো রিয়েল অ্যাস্টেট ব্যবসায়ী ও তেল ব্যবসায়ী।

 তারপর তারা জোট বেধে বাজার থেকে বেশি দামে চাউল কিনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পরে দাম বাড়িয়ে বাজারে ছেড়ে দেয়। এদের এই মনোপলিতে প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার।

 এই বিড়ি, ওষুধ, রিয়েল অ্যাসটেট কোম্পানিগুলো নিত্য পণ্যের বাজার দখল করে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো দাম নির্ধারণ করছে। আর এদের হয়ে সাফাই দিচ্ছে সরকার। বলা হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই মূল্য বৃদ্ধি। যা ডাহা মিথ্যা কথা ছাড়া আর কিছু না। 


বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে শুধু গম কিনত। অথচ গমের দাম বৃদ্ধি হয়েছে যুদ্ধের কয়েক মাস পর। প্রতিবেশী দেশ থেকে গম আনার সুযোগ থাকলেও সরকার অজানা কারণে তা করছে না। কেন করছে না? তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। ওই বিড়ি, ওষুধ, রিয়েল অ্যাস্টেট কোম্পানির ব্যবসা জমানোর জন্য এসব করছে। যাতে আগামীতে এদের হাত ধরেই সরকার টিকে থাকে। 

বাংলাদেশের আয়ের প্রধান উৎস দুটি খাত। একটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও দ্বিতীয়টি গার্মেন্টস পণ্য। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে এই দুটি খাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। পোশাক খাতে কেউ বলেনি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাদের অর্ডার কমে গেছে। বরং তারা বলছে সময় মতো মাল সরবরাহ না করলে তাদের অর্ডার বাতিল হতে পারে।

 অন্যদিকে প্রবাসীদের বেশির ভাগ আয় আসে মধ্য প্রাচ্য থেকে। সেখানকার শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স। পোশাক খাতের বড় ক্রেতা আমেরিকা ও ইউরোপ।
তাহলে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এখানে কীভাবে ভূমিকা রাখছে?

 আর বাংলাদেশ আগা গোঁড়া ডলারে ব্যবসা করে। আর ডলার বিশ্বের তাঁবর তাঁবর কারেন্সিকে ধসিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ডলার নির্ভর হওয়ার কারণে তার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবার কথা। অথচ আমরা ডলার সংকটের কথা বলছি। 

বলা হচ্ছে, বিশ্ব মার্কেটে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। যে কারণে আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ব বাজারে ওঠা নামা করে। প্রতিটি দেশ সেই হিসাব করেই কৌশল নির্ধারণ করে থাকে। বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের  দাম নির্ধারণ করেছিল নিজেদের বাজারের ওপর ভিত্তি করে।

বিশ্ব বাজারে যখন জ্বালানি তেলের মূল্য কম ছিল বাংলাদেশের লোকজন তখন বেশি দাম দিয়ে জ্বালানি কিনত। তখন কিন্তু সরকার কম দামে জ্বালানি দেয়নি। আবার যখন বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তো সরকার তখন জ্বালানির ওপর ভরতুকি দিয়ে দাম ঠিক রাখতো। এভাবে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করত সরকার। এখন বলা হচ্ছে জ্বালানি তেলের কারণে রিজার্ভে চাপ পড়ছে যা সত্য নয়। 

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার কারণে এদেশে তেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গুলোর নির্ভরতা কমে আসছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।  তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে সেই কুইন রেন্টাল চালু করার জন্য তেলের দরকার পড়ল? বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসকে সিএনজি করে যে ব্যবসা শুরু হলো তার মুনাফার টাকা গেল কোথায়? 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দ্রব্য মূল্যের দাম নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়। কয়েকটি বৈঠকে দেখেছি বাণিজ্য মন্ত্রী ও সচিব সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান। যেমন বাণিজ্য মন্ত্রী ও সচিবকে যদি ডিমের দাম বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তিনি বলেন এটা মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজ। চাউলের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বলা হয় এটা খাদ্য মন্ত্রীর বিষয়। এভাবে দিনের পর দিন এসব লোক দেখানো বৈঠক হয়। যার ফলাফল শূন্য। 
 

ঢাকানিউজ২৪.কম / এসডি

আরো পড়ুন

banner image
banner image