
আশিক মুস্তাফা
২০১৯ সালের এপ্রিলের কথা। বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের আমন্ত্রণে শিশুসাহিত্যের ওপর একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। মুহম্মদ জাফর ইকবালও গিয়েছিলেন তিন দিনের সেই কনফারেন্সে। অতিথি হয়ে। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়ে তোলা পাঠভবনে পড়ূয়ারা সাহিত্যসভা বসায়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। পাঠভবনের শিক্ষার্থীরা বসে তিন লাইনে। তারপর একজন করে আসে। লাইন থেকে। গল্প-ছড়া-কবিতা-গান শোনায়।
স্বরচিত। কখনও রবীন্দ্রনাথের। মাঝেমধ্যে আবার দলবেঁধে নৃত্যও করে। এমন সাহিত্যসভায় আগে কখনও থাকার সুযোগ হয়নি। যে গল্প পড়ে, তার গল্প শেষ হলে সবাই বলে- সাধু সাধু। যার ছড়া-কবিতা, যার গান এবং যার নৃত্য যত ভালো হয়, তার জন্য তত বেশি সাধু সাধু উচ্চারিত হয়।
পরদিন গিয়েছিলাম পাঠভবন দেখতে। আমাদের স্কুলের মতো সেই পাঠভবনেও পড়াশোনা হয়। তবে আমাদের ক্লাসরুমের মতো সেখানে কোনো ক্লাসরুম নেই। ক্লাস বসে ঠিকই। গাছের তলায়। শিক্ষকও বসেন গাছের তলায়। স্যারকে ঘিরে বসেন ছাত্রছাত্রীরা। স্যার পড়ান। কারও ইচ্ছে হলে শোনে। কেউ চাইলে গাছের ডালে বসা পাখির সঙ্গে গল্পও জমাতে পারে। মাটিতে কুটকুট করে হেঁটে যাওয়া পিঁপড়ের সঙ্গে কথা বললেও চোখ রাঙায় না স্যার। জাফর ইকবালকে পেয়ে ছোটরা ঘিরে ধরে। গল্প শুনতে চায়। জাফর ইকবাল তাদের গল্প শোনান। গল্প শুনে সবাই বলল- সাধু সাধু। আমিও খুব মুগ্ধ হয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের গল্প শুনলাম। পাঠভবনে পড়ূয়াদের সঙ্গে সাধু সাধু বললাম। আর খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলাম জাফর ইকবালকে। আমার চোখে চোখ পড়ল তার। তিনি চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলেন। তার এই হাসিটা বড্ড পরিচিত।
সেই তিন দিন খুব কাছ থেকেই দেখেছি মুহম্মদ জাফর ইকবালের উচ্ছলতা, সরলতা এবং শিশুদের জন্য তার উদারতা। সহজ-সরল জীবনযাপন আর ছোটদের সঙ্গে সহজে মেশার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে তার। এমনই তো হওয়ার কথা ছোটদের একজন জনপ্রিয় লেখকের।
ছোটদের প্রিয় এই লেখকের লেখালেখির শুরুটাও বেশ অদ্ভুত। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয় তার লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশন গল্প 'কপোট্রনিক ভালোবাসা'। পরবর্তী সময়ে একই ধরনের আরও বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায়। এ গল্পগুলো নিয়েই পরে 'কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ' বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি পড়ে শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ আরও অনেকেই প্রশংসা করেছিলেন। সেই থেকে নিয়মিত লিখছেন তিনি।
শিশু-কিশোরদের কাছে খুব প্রিয় নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। 'আমি তপু', 'টুকুনজিল', 'দস্যি ক'জন', 'রাশা', 'মেকু কাহিনী', 'বৃষ্টির ঠিকানা'সহ অসংখ্য জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাসের লেখক তিনি। তবে বিজয়ের মাসে মনে পড়ছে তার লেখা ২২ পৃষ্ঠার বই 'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস'-এর কথা। জাফর ইকবাল চেয়েছিলেন, তার লেখা এই বই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ূক। হয়েছেও তাই! তার এই বইটি সবচেয়ে পঠিত মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসমৃদ্ধ বই!
১৯৭১ সালের ৫ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল জাফর ইকবালের বাবা ফয়জুর রহমান আহমদকে। বইটির পাতায় পাতায় দেশের জন্য মায়া আর দরদ ছড়িয়ে পড়েছে হয়তো বাবার জন্যই। বাবার মতো লাখো মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়ে যে বিজয় এসেছে আমাদের, সেই বিজয়ের মাসেই তার জন্ম। ১৯৫২ সালের আজকের এই দিনে। বাংলা শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই লেখকের আজ ৭০তম জন্মদিন। জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে, প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
সাংবাদিক ও শিশু সাহিত্যিক
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: