নাইজেল গ্রিন
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ দেওয়ার পারস্পরিক হুমকির কারণে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের ভাবনার চেয়ে গভীর ও দ্রুত হতে পারে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে পাকিস্তানে ভারতের সামরিক অনুপ্রবেশ ‘আসন্ন’।
সীমান্তে এরই মধ্যে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে ভারত। একই সময়ে নয়াদিল্লি এই হামলার দায় স্বীকারকারী সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্য ইসলামাবাদের যোগসূত্র আছে বলে দাবি করার পর বিকল্পগুলো খুঁজছে। যদিও এই হামলায় নিজেদের যোগসূত্র অস্বীকার করেছে ইসলামাবাদ।
যেহেতু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেহেতু পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল সংঘাতের ঝুঁকি প্রতি ঘণ্টায়ই বাড়ছে। বাজার অনিশ্চয়তাকে ঘৃণা করে। আর সর্বশেষ এই উত্তেজনার ঢেউ দেখা দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর সব সময়ই উত্তেজনার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল। কিন্তু, বর্তমান অচলাবস্থাটা তৈরি হলো আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত এক সময়ে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন ভঙ্গুর। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর তাগিদ ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বড় অর্থনীতিগুলো সুরক্ষাবাদের দিকে ক্রমেই পিছু হটছে।
এরই মধ্যে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে ভারতীয় রুপি ও পাকিস্তানি রুপির বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতার কথা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের ব্যবসা সুরক্ষিত করার পথ খুঁজছেন। বন্ড বাজারগুলোতেও ভূরাজনৈতিক নতুন ঝুঁকি বিবেচনায় মূল্য নির্ধারণের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার এরই মধ্যে টালমাটাল। নতুন যুদ্ধ শুরু হলে এই সব বাজারে আরেক দফা বড় ধাক্কা লাগবে। বিশেষ করে জ্বালানি সরবরাহ ও প্রধান আঞ্চলিক বাণিজ্যপথের ওপর হুমকি তৈরি হলে বড় ধাক্কা লাগবে।
বিনিয়োগকারীদের কাছে ভারত খুবই আকর্ষণীয় স্থান। ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বড় অর্থনীতি। উদীয়মান বাজারটি বিশ্বের অন্যতম পাওয়ার হাউস, যেখানে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে। বড় কোনো সংঘাত হলে ভারতের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ পরিকল্পনা লাইনচ্যুত হতে পারে, সরবরাহশৃঙ্খলায় ব্যাঘাতের সৃষ্টি হতে পারে এবং ব্যবসার পরিবেশের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে।
ফলে ভারতের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর (প্রযুক্তি জায়ান্ট থেকে শুরু করে জ্বালানি খাতের প্রধান) ব্যবসার ওপরও ধারাবাহিক প্রভাব পড়তে পারে।
অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি, রুপির দুর্বল মান ও ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে পাকিস্তানের অর্থনীতি এমনিতেই বড় চাপের মধ্যে আছে। বড় কোনো সংঘাত হলে সেটা গভীরতর অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়বে। সংঘাত টেনে নিয়ে যেতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই বাইরের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে। সেই অর্থ তাদের সম্ভব হলে আইএমএফ, না হয় চীনের মতো মিত্রদের কাছ থেকে নিতে হবে।
ফলে, আঞ্চলিক জোটের হিসাব-নিকাশ বদলে যাবে। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আসবে।
ভারত ও পাকিস্তানের কেউই প্রথম সারির তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের দামামা বাজলে সেটা জ্বালানির সরবরাহ পথগুলো এবং জাহাজ চলাচলের রুটগুলোয় বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তাতে যেমন ইনস্যুরেন্স খরচ বাড়বে এবং এরই মধ্যে নাজুক অবস্থায় থাকা সরবরাহ ব্যবস্থায়ও খরচ বাড়বে। অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি বাস্তব।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে যা ভাবা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বৈশ্বিক প্রভাব পড়তে পারে। আগেরবার ওয়াশিংটন ও বেইজিং হস্তক্ষেপ করে উত্তেজনা প্রশমিত করেছিল। কিন্তু এখন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা আরও অনেক বেশি নাজুক।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের ভেতর সংঘাত গ্রাস করছে। চীন আন্তর্জাতিকভাবে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এত দিন যে কূটনৈতিক সুরক্ষা পেতেন, সেটা ক্রমেই পথহারা হচ্ছে।
জ্বালানির বাজার বিশেষ করে উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে। ভারত ও পাকিস্তানের কেউই প্রথম সারির তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের দামামা বাজলে সেটা জ্বালানির সরবরাহ পথগুলো এবং জাহাজ চলাচলের রুটগুলোয় বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তাতে যেমন ইনস্যুরেন্স খরচ বাড়বে এবং এরই মধ্যে নাজুক অবস্থায় থাকা সরবরাহ ব্যবস্থায়ও খরচ বাড়বে। অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ার বিষয়টি বাস্তব।
বিনিয়োগকারীরা অবশ্যই এই সংঘাতের অপ্রত্যক্ষ প্রভাবও বিবেচনা করবেন। ভারতের দিক থেকে সিন্ধুর পানি চুক্তি স্থগিত এবং ভারতীয় বিমানের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করার ঘটনা শুধু প্রতীকী কর্মকাণ্ড নয়। এসব পদক্ষেপে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হতে পারে।
কৃষি উৎপাদন অঞ্চলে পানির ঘাটতি হলে পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। আর বিমান চলাচলের ওপর বিধিনিষেধে পর্যটন ও মালামাল পরিবহনে ভারতের খরচ বাড়বে।
আঞ্চলিক এই উত্তেজনা প্রযুক্তি খাতের ওপরও প্রভাব ফেলবে। ভারতের প্রযুক্তিশিল্প উদীয়মান। প্রযুক্তি খাতে বৈশ্বিক যৌথ মূলধনী উদ্যোগ, আউটসোর্সিং চুক্তির বিশাল ক্ষেত্র ভারত। ফলে প্রযুক্তি খাতের ব্যবসা ভারতে স্থিতিশীলতা চায়।
নিরাপত্তা পরিস্থিতির যদি বড় অবনতি হয়, তাহলে প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে বিলম্ব করতে পারে অথবা অন্য কোথাও বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে পারে।
এই উচ্চতর ঝুঁকির মধ্যেও যাঁরা সঠিকভাবে অবস্থান ঠিক করতে পারবেন, তাঁদের জন্য সুযোগ থাকবে। প্রতিরক্ষা খাতের প্রতিষ্ঠান ও সাইবার নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চাহিদা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
নাইজেল গ্রিন বিশ্লেষক ও লেখক, এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত