মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি মাথায় রেখে দ্রুত পরিবর্তন এবং ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান গতিশীলতার মধ্যে ফিলিস্তিনিরা এই আঞ্চলিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে কতটা প্রস্তুত, সে প্রশ্ন তোলা বাহুল্য হবে না। দুই বছরের গণহত্যার পর এ বিষয়গুলো তাদের সামনে এসেছে। ফিলিস্তিনিদের কেবল পরিণতিকে গ্রহণ করার পরিবর্তে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে এই অঞ্চল গড়ে তোলা এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য একটি দূরদর্শী প্রক্রিয়া যুক্ত থাকা উচিত।
এ ধরনের দূরদৃষ্টি কোনো বিলাসিতা নয়, বরং এই সময়ে এটি দরকার। বিশেষ করে, যেহেতু গত দুই বছর ধরে ইসরায়েল আরও প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। জবাবদিহির জন্য দৃঢ় প্রতিক্রিয়া বা ব্যবস্থা ছাড়া ইসরায়েল আরও ‘ময়দানে নিজেদের অবস্থান’ জোরাল করতে থাকবে এবং শর্তহীন মার্কিন সমর্থনের মাধ্যমে অঞ্চলটি তাদের ইচ্ছামতো গুছিয়ে নিতে থাকবে।
যদি এই আধিপত্যের জবাব কেবল আনুষ্ঠানিক সভা, নতুন নতুন সম্মেলন ও বড় বড় কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং ইসরায়েলকে দমন করার জন্য বাস্তব কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ফিলিস্তিনিরা উপেক্ষিত থাকবে। সেটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দুটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই নতুন বাস্তবতা নিশ্চিত করতে কোনো কিছুই ইসরায়েলের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান গতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের কাছে এটি অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত আঞ্চলিক আরব মিত্র রয়েছে, যা ফিলিস্তিনি জনগণের মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় গুরুতর হুমকি তৈরি করছে। জটিলতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এই সত্য যে, এই অঞ্চলটি আগের চেয়ে আরও বেশি সামরিকীকরণ ও নিরাপত্তা ইস্যুপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য এখন বিশ্বব্যাপী এক-চতুর্থাংশেরও বেশি অস্ত্র আমদানি করছে। এ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি বা মানবিক নিরাপত্তার যে কোনো সম্ভাবনার জন্য এটি অশুভ ইঙ্গিত। কারণ বেশির ভাগ কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার কাছে অগ্রাধিকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়, বরং তাদের নিজেদের টিকে থাকা ও সুরক্ষা দেওয়া। এটি আরব জনগণের নিজস্ব স্বাধীনতার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করবে। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য এমন এক স্বাধীনতা, যা তাদের উপকার বয়ে আনবে।
‘যুদ্ধ’ অথবা ‘শান্তি’– এই দুই পরিস্থিতির জন্য ফিলিস্তিনিরা কতটা প্রস্তুত? নাকি তারা ভবিষ্যতের গতিপথ পুনর্গঠন কাজে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে কেবল দর্শক হয়ে থাকবে; নানা ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাবে? আজ আগের চেয়েও বেশি মাত্রায় ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই এই অঞ্চল সম্পূর্ণ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পড়তে ও বিশ্লেষণ করতে হবে; অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়। ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক গতিশীলতার মধ্যে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্সি বা স্বত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ইরানের নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরোধ অক্ষ’র পতনের পরিণাম ফিলিস্তিনিরা কীভাবে মোকাবিলা করছে? এর কার্যকারিতা নিয়ে যতই সংশয় থাকুক, এটি স্পষ্টত ইসরায়েলি-মার্কিন আধিপত্যের জবাব হিসেবে কাজ করেছে। আজ এই অক্ষ দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য এবং ফিলিস্তিনের অবস্থান কী হবে? এসব প্রশ্নের জবাবে ফিলিস্তিনবাসীর উত্তর তাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনার ভিত্তি গঠনে ভূমিকা রাখবে।
দূরদর্শিতার আরেকটি দিক হলো, এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ গঠনকারী নেতা ও প্রভাবশালীদের ভূমিকা কী দাঁড়াচ্ছে, আর ফিলিস্তিনিরা কতটা এগিয়ে যাচ্ছে, তা পুরোনো ও পরিচিত ধরনগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ারও প্রয়োজন নেই।
এই অঞ্চল পূর্ব দিকে ঝুঁকছে এবং কৌশলগত অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ক্রমশ প্রশ্ন উঠছে। চীন ও ভারতের সঙ্গে বড় অর্থনৈতিক চুক্তি, এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য এবং বিশাল অবকাঠামো বিনিয়োগের মধ্যে, আগামী দশকে এ অঞ্চলকে রূপ দিতে অর্থনৈতিক করিডোরগুলোর দিকে একবার নজর দেওয়া দরকার। ফিলিস্তিনিরা এই মৌলিক রূপান্তরগুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে?
আগামী দিনে ফিলিস্তিনিদের সৌদি আরব এবং মিসর– এ দুটি প্রধান আঞ্চলিক পক্ষের ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত, যাদের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক পরিবর্তন করতে হবে। সৌদি আরব বর্তমানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য নতুন বৈশ্বিক জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং এটিকে নতুন অসলো চুক্তির কাঠামোতে রূপান্তরিত হওয়া থেকে বিরত রাখা অপরিহার্য। এ জন্য ফিলিস্তিনি এবং তাদের সৌদি প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি শক্ত সংলাপ প্রয়োজন।
গাজার পুনর্গঠন ও সেখানে ভবিষ্যতে যে শাসন পদ্ধতি কার্যকর করা হবে, তা হবে আসল পরীক্ষা। এগুলো কেবল ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের জন্যই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের ভবিষ্যতের জন্যও। এ সবকিছুর জন্য আঞ্চলিক গুরুত্ব ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একটি বৈধ, প্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের দাবি দরকার।
দুই বছরের গণহত্যার পর দৃষ্টিভঙ্গি গত ৩০ বছরের মতো থাকতে পারে না; নেতৃত্বের জায়গায়ও পরিবর্তন দরকার। এ কারণেই একটি আন্তরিক, যথাযথ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বাধীন জাতীয় সংলাপ আগের চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে, যা যে কোনো আঞ্চলিক অভিভাবকত্ব থেকে মুক্ত। কেবল এ ধরনের প্রকৃত জাতীয় সংলাপের মাধ্যমেই ফিলিস্তিনিরা দ্রুত পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক পরিস্থিতির জন্য কার্যকরভাবে প্রস্তুত হতে পারে। তা এখনই দরকার।
ড. আলা তারতির: সিনিয়র গবেষক, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক; মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম




