ঢাকা  মঙ্গলবার, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ          সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

spot_img
Homeখোলা কলামনির্বাচনী রাজনীতি

নির্বাচনী রাজনীতি

প্রফেসর ড. এসকে আকরাম আলী

রাজনীতিতে নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। গণতান্ত্রিক সমাজে সরকার পরিবর্তনে নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং এটি এমন এক সাংবিধানিক প্রক্রিয়া যা সংসদীয় বা প্রেসিডেন্টীয় যে কোনো শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের বৈধ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী কৌশল তৈরি করে এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল তাদেরকে এক ঐতিহাসিক বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর তখন ব্যর্থতার মুখে পড়ে। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন অরাজনৈতিক সরকার পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

ব্রিটেনে সংসদীয় পদ্ধতির এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টীয় পদ্ধতির সূচনা হয়। উভয় দেশই দুই দলীয় রাজনীতির সংস্কৃতি বিকাশে সক্ষম হয় এবং নির্বাচনের সময় তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে কাজ করে, ক্ষমতার জন্য সংঘাত এড়িয়ে চলে। ভারত ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশও তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাব বজায় রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে নির্বাচনী রাজনীতি
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের একই সাংবিধানিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে। অবিভক্ত ভারতে প্রথম নির্বাচন ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও آل ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রধান দুটি দল ছিল যারা সমগ্র ভারতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। মুসলিম লীগ বেঙ্গল, পাঞ্জাব, সিন্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, আর কংগ্রেস কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং ব্রিটিশ ভারতে প্রথম দেশীয় সরকার গঠন করে।

এই সময় দুই দলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়, যা পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম দেয়। তবে পাকিস্তান শুরু থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় এবং সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের ভাঙন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে এ নির্বাচন-ভিত্তিক রাজনীতিই মূল কারণ হিসেবে দেখা যায়।

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তারা পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক কৌশল গ্রহণ করে একটি ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। কিন্তু এরপরের রাজনীতি এত নোংরা হয়ে ওঠে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো হয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের মধ্যে ছিল। দেশীয় রাজনীতি বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হলে নির্বাচনী রাজনীতি তার গুরুত্ব হারাতে থাকে। শেখ মুজিবের শাসনের পতন হয় ১৯৭৫ সালের আগস্টে।

জিয়াউর রহমানের সময় বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়। কিন্তু এরশাদের সামরিক শাসন ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এই সংস্কৃতি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

১৯৯০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দ্বিদলীয় নির্বাচন ব্যবস্থা সফল ছিল, কিন্তু ভারতীয় আধিপত্যবাদের কারণে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে র-এর প্রত্যাবর্তন ঘটে। এরপর থেকে নির্বাচন-ভিত্তিক রাজনীতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং শেখ হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে।

ভবিষ্যতের রাজনীতি
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আর জামায়াতের দাবি হলো নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে।

একটি নতুন ছাত্রনেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। জামায়াত ইসলামি একটি বৃহত্তর ইসলামী জোট গঠন করতে পারে, যেখানে বিএনপি পুরনো মিত্রদের নিয়ে আলাদা জোট গঠনে এগোতে পারে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী রাজনীতি কেমন হবে তা গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ঠেকাতে রাজনৈতিক দলগুলোর দেশপ্রেম ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। এটি আমাদের জন্য আল্লাহর দেওয়া শেষ সুযোগ। আমরা হয় সফল হবো, নতুবা চিরতরে ব্যর্থ।

লেখক : সম্পাদক, মিলিটারি হিস্ট্রি জার্নাল এবং আইন ও ইতিহাসের অধ্যাপক।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular