অলোক আচার্য
ভালো নেই ধরিত্রী। এখন পর্যন্ত এই মহাবিশ্বের বসবাস উপযোগী একমাত্র গ্রহ পৃথিবী বা ধরিত্রী। তবে এই বসবাসযোগ্য সুন্দর ধরিত্রী ক্রমেই বসবাসের অনপুযুক্ত হয়ে উঠছে। মানুষের আচরণ এবং অসম ব্যবহারের ফলে ক্রমশই এই ধরণীর পরিণতি ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঠিক কতদিন এই ধরিত্রী মানুষের বসবাসের উপযুক্ত থাকবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। মানুষ এখন ভিনগ্রহে বসবাসের সম্ভ্যাব্যতা যাচাই করছে। ধরিত্রী যেসব কারণে আজ বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে তার মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু পরিবর্তন,দূষণ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ বা হানাহানি। এই তিনটিই ঘটছে মানুষের কারণে। প্রকৃতি কেবল দায় শোধ করছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে তীব্র তাব প্রবাহ চলছে। যা নিয়ে জনজীবন রীতিমতো বিপর্যস্থ। কাঠফাঁটা রোদে মানুষের প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রী পার হয়েছে। অথচ একসময় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পার হলেই আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হতো। এই তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে বলেই আভাস পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাপপ্রবাহের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশের আবহাওয়া এই মুহূর্তে মরুভূমির মতো মনে হচ্ছে। এই সুন্দর পৃথিবীর এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। যে গতিতে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে তাতে অচিরেই পৃথিবীর কোনো কোনো দেশ ভয়াবহ সংকটে পরতে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও অধিকাংশ দেশের জন্য হুমকি। এই হুমকি মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিযোজন শব্দটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। পৃথিবীর বাতাস ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অথচ এই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল একসময় সুশীতল, বিষমুক্ত ছিল। সেই আগের মতো বাযুমন্ডল পেতে হলে কমপক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বায়ুমন্ডল হয়ে উঠবে সেই ১০০ বছর আগের মতো। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইটিএইচ জুরিখ) একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল, শুধুমাত্র গাছ লাগালেই আসন্ন সংকট থেকে সমাধান সম্ভব।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তাতে অনেরক নিচু শহর মারাত্বক হুমকিতে রয়েছে। আর শিল্পায়নের জোয়ারে বাতাসে কার্বনডাইঅক্সাইড বেড়েই চলেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এক লাখ কোটি গাছ লাগাতে জমির অভাব হবে না। হিসেব করে দেখিয়েছে, যদি আপনার সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা থাকে দ্রুত এক লাখ কোটি গাছ বসিয়ে ফেলার তাহলে অন্তত জায়গার অভাবে সেসব গাছের বেড়ে উঠতে ও বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। গাছ কাটতে কাটতে পরিবেশ এতটাই রুহ্ম করে ফেলেছি যে এখন প্রতিদিন গাছ না লাগালে আর সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তাই এসি কিনে সমস্যার সমাধান না করে বরং গাছ লাগিয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজি। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭% এর বেশি না। ঢাকাতে যত পরিমাণে গাছ কাঁটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ধারনাটি আরও কয়েক দশক আগে থেকেই জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু আলোচনার সাথে সাথে জলবায়ু জনিত পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে কার্যত জলবায়ু পরিবর্তিত হয়েছে এবং সারাবিশ্ব এখন এর ফল ভোগ করছে। উন্নত বা অনুন্নত দেশ কেউ এর প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না। তবে সক্ষমতা বিবেচনায় এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণে কারও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ রয়েছে আর কারও সে সামর্থ্য কম। আজ জলবায়ু পরিবর্তনে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক. জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করা। দুই. অভিযোজন করা অর্থাৎ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। গত বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সব দেশ সম্মত হয়েছে। কার্যত গত পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ দিক বেশ ভালোই বুঝতে পারছি।
তীব্র শীত বা খরা, অতিবৃষ্টি, প্রলয়ঙ্করী ঝড়, তীব্র তাপদাহ, অসময়ে বন্যা, ভূমিধস, টর্ণেডো ও সুনামীর মত মারাত্বক সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশ্বকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। গত ২০ বছরে বিশ্বে চরম আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এতে মানুষের পাশপাশি অর্থনীতিরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটনা বৃদ্ধিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য বিশ্ব বসবাসের অযোগ্য নরকে পরিণত হয়ে উঠছে। জাতিসয়ঘের মতে, আগামী এক দশকে পৃথিবীর জন্য তাপপ্রবাহ এবং খরা সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে আছে। এর আগে জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সংক্রান্ত অফিস ’ইউএনডিআরআর’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে ফলপ্রসু ব্যবস্থা নিতে বিশ^ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের ব্যর্থতায় এই গ্রহ ধীরে ধীরে কোটি কোটি মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য নরকে পরিণত হচ্ছে। মানুষ নিজেদের আপাত টিকে থাকার জন্য, সুখে রাখার জন্য যে ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড করছে তার ফলে সমস্ত প্রাণীকুলের অস্তিত্ত এমনকি পৃথিবীর অস্তিত্তই বিপন্ন করছে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এমনকি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ঘটছে,মানুষের সম্পদের বিনষ্ট ঘটছে,স্থানচুত্যি ঘটছে এবং জীবিকার পরিবর্তনের মানুষের জীবনযাপনে বিরুপ প্রভাব পরছে। আবহাওয়ার চরিত্র দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ বদলাচ্ছে। ষড় ঋতুর এই দেশে এখন ছয়টি ঋতু আলাদা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। রীতিমত নাম গুণে বের করতে হয় কিন্তু দেখা মেলে না। কারণ যখন যে আবহাওয়া থাকার কথা তখন তা থাকছে না। শীতের সময়ে খুব অল্প সময় শীত অনুভূত হয়। যখন গরম আসার কথা তখন শীত থাকে। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি তো আমাদের লেগেই আছে। প্রকৃতি তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। আমরাও প্রকৃতির খেয়ালের সাথে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছি। তবে কতদিন থাকবে সেটাই প্রশ্ন। যার যেখানে ইচ্ছা জমি,বন উজাড় করে বাড়িঘর তৈরি করছে। বাতাসে নানা কারণে দূষিত ও ক্ষতিকর কণা মিশে যাচ্ছে। কলকারখানা,যানবাহন ও জীবাশ্ম জালানী পোড়ানোর কারণে এসব ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাসে মিশে বাতাস বিষাক্ত করে তুলছে। এসব ইমারত নির্মাণ করতে প্রতিদিন ক্ষতিকর কণা বাতাসে গিয়ে মিশছে। সেই বাতাস থেকে আমাদের ফুসফুসে স্থান পাচ্ছে। নদ-নদী মরে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ধ্বংস হচ্ছে।
ফলে শুষ্ক মৌসুমে এখনই ঢাকা এবং উপকূল অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির অভাববোধ তীব্র হচ্ছে। বিশ্বে সুপেয় পানির সংকট এক মারাত্বক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শব্দ দূষণের তীব্রতা রাজধানী ঢাকাসহ সারাবিশ্বেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সমস্যা। অসচেতনতার কারণে এই সমস্যাও তীব্রতর হচ্ছে। তাছাড়া মাটি দূষণ,আলো দূষণও সমানতালে চলছে। এত খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে ধরিত্রী ভালো থাকে কিভাবে?
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: