জামালপুর প্রতিনিধি : জামালপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে প্রায় দেড়শ বছরের পুরোন রাণীগঞ্জ হাট এখন বিলুপ্তির পথে। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার দুই দিনের এই হাটটি ঘিরেই গড়ে উঠে জামালপুর শহর। এলাকার জনসাধারনের প্রচলিত ভাষায় জামালপুর হাট হিসেবেও পরিচিত।
এই রাণীগঞ্জ হাট ছিলো সবজি, সরিষা, সোনালীআঁশ পাট, ধান, বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য, মাছসহ অন্যান্য পণ্যের রমরমা পাইকারী কেনা-বেচার ভরসার স্থল। দূরদুরান্তের গ্রাম-গঞ্জের জনসাধারণরা সংসারের বাজার করত এখান থেকেই। এই হাটটি ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে এখন মৃত প্রায়।
ধারনা করা হয়, উত্তাল যমুনা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে বনে আছন্ন এই অঞ্চলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া প্রায় ২৩৮ কিলোমিটারের বংশ নদীর ওপর দিয়ে ব্যবসায়ী ও সওদাগরদের বিশাল বিশাল বজরা নৌকা চলাচল করত উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে। যাওয়া আসার সময় ব্যবসায়ি ও সওদাগররা বনাঞ্চালে মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশ নদীর ধারে এই অঞ্চলে গড়ে তোলে বিশ্রামের স্থান। বংশ নদীর তীরবর্তী বিশ্রামের এই জায়গাটিতে একটি গঞ্জ গড়ে উঠে। কালক্রমে এই এলাকাটি গঞ্জের হাট নামে পরিচিতি লাভ করে।
এছাড়া পৌরভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায়িক সুনাম ছড়িয়ে পড়ার কারনে ১৯১৩ সালে সিএস অনুযায়ী প্রায় দশ একর জমির উপর একটি বাজার করা হয়। যার পশ্চিমে ছিলো বংশ নদী এবং পুর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ। পরে নাটোরের রাণী চৌধুরাণীর নামে এই হাটের নামকরণ হয় রাণীগঞ্জ হাট।
তবে জনশ্রুতি আছে, বংশ নদী দিয়ে শুধুমাত্র এদেশীয় ব্যবসায়ীরাই নয় এখান দিয়ে চলাচল করতো ভিনদেশের বণিকদের বিশাল পালতোলা নৌকা। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য সৃষ্টি হয় হাটের কাছাকাছি যৌনপল্লী ও পানশালা। বিদেশী বণিকরা এদেরকে রাণী বলে সম্মোধন করত এবং একারনে হাটটির নাম ছিলো রাণীর হাট। কালক্রমে বদলে গিয়ে রাণীর হাট থেকে হয়েছে রাণীগঞ্জ হাট।
লোকমুখে আরো জানা যায়, হাটের পাশাপাশি ধীরেধীরে জনবসতি গড়তে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে দখল হতে শুরু করে বংশ নদীর তীর। যা এখন নর্দমার খাল হয়ে বেঁচে আছে। এরপর ব্রহ্মপুত্র নদের চাপাতলা ঘাট (বর্তমানে কড়ই তলা) এবং বিটি ঘাট (যার কোন চিহ্ন এখন আর নেই) ব্যবহার করে হাটটি যৌবন ফিরে পেলেও শহর রক্ষার্থে নদের গতিপথের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে নদটির গতি চলে যায় আরেক দিকে ফলে বন্ধ হয়ে যায় ঘাট গুলো। দখলদারদের দখলে চলে যায় রাণীগঞ্জ হাটের জমি এবং হাট হয়ে যায় সঙ্কুচিত যা এখন বিলুপ্তির পথে।
অত্র হাটের বর্তমান ইজারাদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার বয়স কম তাই হাট সম্পর্কে বেশি কিছু জানিনা। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি এক সময় এই হাটে ক্রেতা বিক্রেতারা আসতো প্রচুর লোক সমাগম ঘটত। বেচাকেনাও হতো প্রচুর। রাত ১১টা পর্যন্ত হাটে জনসাধারনে ভরপুর থাকতো। বর্তমানে শহরের বিভিন্ন স্থানে দৈনিক বাজার গড়ে উঠায় এখন আর তেমন লোক সমাগম হয়না। বেচাকেনাও কমে গেছে, ইজারার টাকা তোলা এখন কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাটে আসা জনৈক ক্রেতার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি অনেক ছোটকাল থেকেই এই হাটে আসি, তখন ধান,সরিষা,পাট প্রচুর পরিমানে উঠতো। পাইকারি বেচাকেনা হতো, অনেক সবজি ও মাছ বিক্রতারা আসতো। এখন আর তেমন কিছু পাওয়া যায়না। তারপরেও আসি, এ যেনো এক ধরনের মায়া। আপনাদের লেখনীর মাধ্যমে হাটটি বাঁচানো যায় কিনা দেখেন।
জানা যায়, দেরশ বছরের পুরোন হাটটি দৈনিক বাজরে রূপান্তর করার পরিকল্পনা পৌরসভার রয়েছে। হাটে স্থাপনা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।
এবিষয়ে জামালপুরের বিশিষ্ট সমাজসেবক ও মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, এই হাটটি জামালপুরের ঐতিহ্য। এটা দৈনিক করার চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে সাপ্তাহিক হাটই রাখতে হবে এবং হাট হিসেবেই জনপ্রিয় করতে হবে। এখনে এখনো বেশ কয়েকটি পাটের কুঠি রয়েছে। এই হাটে এখনো পাট চাষী এবং পাইকারা আসে। পুরো জামালপুরের পাট এখানে বেঁচাকেনা হয়।ধান,পাট,সরিষা,মরিচ,সবজি আবাদী,বাঁশ পন্যসহ পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য এই হাটটি সপ্তাহে দুই দিন হতে পারে।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: