মো. সাঈদুর রহমান
দুর্নীতি আমাদের দেশে এখন ডাল-ভাত। দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি শিরা , উপশিরায় বিশাল আবরণ তৈরী করে ফেলেছে। দুর্নীতি এখন সুনীতির আসনে। দুর্নীতিবাজরা দেশের বিভিন্ন ক্রাইসিস মুহূর্ত যেমন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ,মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা সময় তাদের দুর্নীতির সুযোগের বড় সহায়ক হয়। আমরা করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির করুণ দৃশ্য দেখেছি। বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একটা ক্রাইসিস মুভমেন্ট বলা যেতে পারে।
দীর্ঘ ৫০ বছরের দুর্নীতির আগ্রাসনে দেশের সর্বত্রই মরিচার শক্ত আবরণ পরেছে । এই দুর্নীতি নামক মরিচাকে হঠাৎ করে একেবারে পরিস্কার করা অকল্পনীয় ও দুঃসাধ্য।
এর জন্য দরকার বিবেক নামক শিরিশ কাগজ যা দিয়ে আস্তে আস্তে ঘষে সমাজ থেকে দুর্নীতিকে পরিস্কার করা যাবে । স্বাধীনতার পর থেকে স্বাধীন মানচিত্রেকে নিয়ে টানা- হেঁচড়া করতেছে দুর্নীতিবাজরা।
দেশের সবচেয়ে বড় অশুভ শক্তি হলো দুর্নীতি।
এই দুর্নীতির বেড়াজালে দেশ আটকা পরে গেছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও এ দেশের দুর্নীতি বন্ধ তো দূরের কথা, দুর্নীতি পরিমাণ কমাতেও ব্যর্থ হয়েছে প্রতিটি সরকার । " চোরের বাড়ীতে নাকি দালান হয়না। " কিন্তু দুর্নীতিবাজ চোরদের বাড়ীতেদালান কেন ? সবধরনের দুর্নীতি সমাজে সমান ক্ষতি সাধন করেনা। যেমন - একজন গ্রাম্য মাতাব্বর কিছু টাকা নিয়ে দোষীকে রেহাই দেওয়ার দুর্নীতি আর রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে সরকারী স্থাপনা তৈরী করা আর বালিশ দুর্নীতিকে এক পাল্লায় উঠালে ভূল হবে। বনভূমি ধ্বংস করার দুর্নীতি আর ঘুষ দুর্নীতি এক রকম না । আবার সরকারী ক্রয় কমিটির দুর্নীতি এক অভিন্ন জিনিস। সকল ধরনের দুর্নীতি সমাজ বা রাষ্ট্রের কাঠামোতে কম বেশী আঘাত করে । আর বড় দুর্নীতি গুলি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দেয়।
তাই বড় ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে জরুরী অবস্থা জারী করতে হবে।গুজব দুর্নীতিও দেশের জন্য ক্ষতিকর। যেমন -পদ্মা সেতু।
দুর্নীতিবাজরা দেশ ও জাতির শক্রু । রাষ্ট্রকে আগে চিহ্নিত করতে হবে, কোথায়, কোন খাতে বেশী দুর্নীতি হচ্ছে। টিআইবির প্রতিটি প্রতিবেদনই সরকারি ১৬টি সেবা খাত দুর্নীতির শীর্ষে থাকে! কোন বছর আইনশৃংখলা বাহিনী, আবার পাসপোর্ট অফিস, বিআরটি বা অন্য সেবা খাত। ২০২২ সালের টিআইবির জরিপ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৭৪.৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০.৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮.৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬.৩ শতাংশ।
সেবাধর্মী খাত গুলোতে মানুষের চলাচল বেশী থাকে তাই দুর্নীতিও বেশী হয় । এক বছরের
দুর্নীতির অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরী করা সম্বব। সেবা খাতে বছরে দুর্নীতি হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, তারমধ্যে ঘুষ দুর্নীতি হয় ৯ হাজার কোটি টাকা । ঘুষ দুর্নীতি হয় বাজেটের ৩.৭ শতাংশ জিডিপির ০.৬ শতাংশ।
উচ্চ আয়ের তুলনায় নিন্ম আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি বেশী হয়।
এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতি গ্রস্থ দেশ ভুটান । সবচেয়ে বেশী আফগানিস্তান তারপর বাংলাদেশ ( তথ্য টিআইবি-২৩)
জাতি হিসাবে আমরা এতই দুর্ভাগা যে আমাদের অবস্থান আফগানিস্থানের কাছাকাছি । বাংলাদেশে দুর্নীতি বৃদ্ধির প্রধান কারন, স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার
দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে অথবা
দুর্নীতিবাজদের অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে । স্বাধীনতার ৫০টি বছর অতীতের গর্ভে চলে গেলেও, রাষ্ট্র
দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির মুখোশ খুলতে ব্যর্থ।এতে করে দেশ দুর্নীতির চোরাবালিতে ডুবতেছে।
দেশ ও সমাজকে একেবারে দুর্নীতি মুক্ত করা অদূর ভবিষ্যতেও সম্বব নয় । কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দুর্নীতি সহনশীল মাত্রায় আনা সম্বব। যেখানে সারা বিশ্ব আজ দুর্নীতির বিষাক্ত ছোবলে বিষগ্রস্থ।
আর এই সব দুর্নীতিবাজরা বাংলাদেশেই বসবাস করেন । প্রকাশ্যে সবাই তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু অন্ধকারে দেয় সবুজ সংকেত । প্রতি বছর সারা বিশ্ব ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলার লুপাট হয়। এরমধ্য ঘুষ দুর্নীতি হয় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার- প্রচারণার কোন ঘাটতি নেই, কিন্তু দুর্নীতিবাজরা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আমাদের দেশের কথা ভেবে অঙ্গিকার বদ্ধ হবো " নিজে দুর্নীতি করবোনা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিবোনা।'' আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মানুষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায় না। একটা জরিপে দেখা গেছে মাত্র ৭.৫ শতাংশ মানুষ দুদকে ( দুর্নীতি দমন কমিশন ) অভিযোগ দাখিল করেন ।তাও তারা এই ভরসায় অভিযোগ জমা দেন, যদি লাইগেয়া যায় । যুগ যুগ ধরে মানুষ দুদকের প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগছে। এই আস্হার জায়গাটা ফিরিয়ে আনার জন্য দুদকে আগে দুর্নীতি মুক্ত হবে। বর্তমান সরকারের সদইচ্ছায় দুদকের কার্যক্রম এখন মানুষের মনে ক্ষীণ আস্থার আলো সঞ্চালন করেছে। সরকার দুদকের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষে মামলা ছাড়াই দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করতে পারবে এই ক্ষমতা দুদককে দিয়েছে। লক্ষ্য রাখতে হবে, আইনের অপব্যবহার যেন না হয়। তাই দুদককে প্রথমে চিনি খাওয়া ছাড়তে হবে। ঘুষ দুর্নীতি থেকে দুদকের প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে মুক্ত করতে হবে । নতুবা এই আইনের অপব্যবহার হবেই ।
দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে, দুর্নীতি মুক্ত রাজনৈতিক দল চাই, দুর্নীতি মুক্ত নেতা চাই, দুর্নীতি মুক্ত সরকার চাই , স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই । প্রতিটা জরিপে উঠে এসেছে সরকারী সেবাধর্মী খাতে দুর্নীতি হয় সবচেয়ে বেশী । তাহলে দুর্নীতির ঐসব চিহ্নিত সরকারী খাত গুলোতে দুর্নীতির বন্ধের উদ্যেগ নিতে হবে। এদের দুর্নীতির মূখগুলোকে সীলগালা করে দিতে পারলে দুর্নীতির পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যাবে। এই সব খাত গুলোকে যথা সম্বব প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবে দরকার সরকার ও দুদকের সমন্বয়ে কার্যকরী অভিযান । সরকারী/ আধা সরকারী অফিস গুলো থেকে দুর্নীতি দূর করতে পারলে, জাতি দুর্নীতির অভিশাপ থেকে অনেকাংশেই রেহাই পাবেন। আইনের দোহাই দিয়ে অথবা গ্রেফতার করে সরকারী অফিস গুলো থেকে সাময়িক ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুফল পাওয়া যেতে পারে ।
কিন্তু কাঙ্খিত ও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পেলে হলে শাসনের পাশাপাশি কাউন্সিলের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও তাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।পাশাপাশি দুদককে প্রকৃত পক্ষে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে শক্তিশালী একটা দুদক গঠন করতে হবে। দুদকের দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রম প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত করতে হবে। প্রতিটি ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের পাঠ্যসূচীতে দুর্নীতি বিরোধী লেখা অন্তর্ভূত করতে হবে। শহরে বসে থাকলে চলবে না। দুর্নীতি এখন সমাজের শিকড় থেকে শিকড়ে বিস্তৃত । দুর্নীতির মূল ও প্রধান উৎস গুলোর মুখ বন্ধ করা অতি জরুরী।যেমন - নিয়োগ বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য, পদোন্নতি বাণিজ্য, ঘুষ বাণিজ্য ইত্যাদি । লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকুরী নিলে তো, ঘুষ না খাইলে; বেহুশ তো হবেই। দুর্নীতি সমাজের একটা পঁচনশীল ব্যাধি। তাই দুর্নীতির বড় প্রতিষেধক হচ্ছে সামাজিক আন্দোলন আর সরকারের সদ ইচ্ছা । রাজনৈতিক জনসভা আর ধর্মীয় জনসভা, সব সভাতেই বক্তাগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জড়ালো বক্তব্য দিতে হবে। নইলে দুর্নীতিবাজরা মুখের ভাষা কেরে নিবে ।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: